Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

নজরুল-সিন্ধুর কয়েক বিন্দু

Icon

মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মধ্য গগনে রবির চমৎকৃত আলোক প্রভায় সাহিত্যাকাশ যখন ঝলমল করছে, সাহিত্যের অন্যান্য তারকারাজি যখন নিষ্প্রভ, ঠিক তখনই প্রবল বেগে ধূমকেতুর মতো স্বমহিমায় আবির্ভূত হন নজরুল। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে নজরুল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বাংলাসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ রূপে। অল্প সময়ে তিনি নিজেকে পরিচয় দিতে পেরেছেন কবি, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক, সম্পাদক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার, সংগীত পরিচালকসহ ইত্যাকার নানারূপে। তার ‘এক হাতে ছিল বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর অপর হাতে ছিল রণতূর্য।’ একদিকে তিনি বিদ্রোহী-বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধ্বজাধারি, অন্যদিকে তিনি প্রেমিক, বিরহী, সন্তান বৎসল পিতা। নজরুলের সাহিত্য ও জীবন নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও এমন কিছু বিষয় আছে যা এখনো অনাবিষ্কৃত। নজরুলের জীবন ও কর্ম মহাসিন্ধুর মতো। যার অনেক কিছুই এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। সেই অনাবিষ্কৃত অংশেরই সামান্য কিছু নিয়ে নজরুল গবেষক এ এফ এম হায়াতুল্লাহর নিবেদন ‘নজরুল-সিন্ধুর কয়েক বিন্দু।’

‘নজরুল-সিন্ধুর কয়েক বিন্দু’ বইটির ছয়টি অধ্যায়ে নজরুলের জীবন ও কর্মের বেশকিছু তথ্য তিনি সংযোজন করেছেন যা ইতঃপূর্বে নজরুলপ্রেমীদের সম্মুখে তেমন প্রকাশ পায়নি। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি ও দিনলিপিতে নজরুল’।

আবু জাফর শামসুদ্দীন সেসব বিরল ব্যক্তিদের একজন যিনি নজরুলের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৪১ সালে নজরুলের সহকর্মীরূপে দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবু জাফর শামসুদ্দীন নজরুলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে নজরুলের মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। এ খুঁটিনাটি বিষয়গুলো অতি সংক্ষেপে লেখক তুলে ধরেছেন পাঠকের জন্য।

কাজী নজরুল ইসলাম তার স্বল্পদৈর্ঘ্য সুস্থ জীবনের পরিসীমায় কমপক্ষে ৩৩ বার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার কবিতা, গান, বক্তৃতায় বাংলাদেশের মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, পেয়েছেন বাংলার মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। এসব কিছুর বিবরণ রয়েছে ‘বাংলাদেশে নজরুল’ শিরোনামাধীন অধ্যায়ে। ১৯৪২ সালে নবযুগ সম্পাদনাকালে ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে একটি অসাধারণ নিবন্ধ লিখে তিনি সমাপ্ত করেছিলেন এভাবে-‘বাঙালিকে বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও-এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালির আমাদের।/দিয়া ‘প্রহারেন ধনঞ্জয়/তাড়াব আমরা করি না ভয়/যত পরদেশী দস্যু ডাকাত/রামাদের গামাদের।/বাঙলা বাঙালির হোক/বাঙালির জয় হোক।’

নজরুল ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা, গোঁড়ামি, সংস্কারাচ্ছন্ন মৃতপ্রায় মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার যে প্রয়াস নিয়েছিলেন তার খুঁটিনাটি বিবরণ রয়েছে ‘গণজাগরণে নজরুল’ নামক অধ্যায়ে।

‘নজরুলের বিমত, অমত, ভিন্ন মত’ শিরোনামাধী অধ্যায়ে বিমত, অমত, ভিন্ন মতের ব্যাখ্যাসহ নজরুল তার বসবাসে সমাজস্থিত বহুমুখী গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এ বিদ্রোহ ছিল পঞ্চমুখী-১) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পদ্ধতি ২) ১৯২০-এর দশকে ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের মূলধারা রচনায় গান্ধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ৩) ইসলামী মৌলবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তৃত্ববাদিতা ৪) হিন্দু সমাজের পূর্বসংস্কার ও সাংস্কৃতিক অন্ধ আনুগত্য এবং ৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেন্দ্রিক বাংলার সাহিত্যিক আধিপত্য গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। এ বিষয়গুলোর ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

‘নজরুল সংগীতে নয়ন বন্দনা’ অধ্যায়টিকে লেখকের গবেষণা কর্ম বলা যায়। এ অধ্যায়ে তিনি দেখিয়েছেন নজরুলের গানের কমপক্ষে ৩৬৫টি গানে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ব্যঞ্জনায় মানব চক্ষুর বর্ণনা, উপমা, চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে ৬২টি গান পরিপূর্ণভাবে মানব চক্ষুর সৌন্দর্য বর্ণনা চক্ষুর দৃষ্টি কীভাবে সম্পর্ক সৃষ্টি করে আর দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে দৃষ্টিপাতকারীর জীবনের বিপর্যয়ের কথা রয়েছে।

নজরুল মহাসিন্ধুর প্রতিবিন্দুই শুধু বাঙালি জাতির নয়, মানব জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরূপ কতিপয় বিন্দুর সংকলন ‘নজরুল-সিন্ধুর কয়েক বিন্দু।’ আমার বিশ্বাস যারা নজরুলপ্রেমী এবং নজরুল গবেষকদের জন্য বইটি সহায়ক হবে।

নজরুল-সিন্ধুর কয়েক বিন্দু : এ এফ এম হায়াতুল্লাহ। প্রকাশক : জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। মূল্য : ২০০ টাকা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম