গল্পের জাদুকর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
লীনা দিলরুবা
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশে দশক বিচার করে যেসব কথাসাহিত্যিকের নাম শোনা যায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে সেভাবে বিবেচনা করা যায় না। যদিও তিনি সত্তরের দশকে লেখালেখি আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু স্বেচ্ছাবিরতির কারণে বাংলা কথাসাহিত্যে তার মূল আত্মপ্রকাশ ঘটে আশির দশকে। নির্দিষ্ট দশকের প্রতিনিধি বলা না গেলেও গুণবিচারে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যেই তার অবস্থান।
প্রকৃতি এক বিপুল ঔদাসীন্য বজায় রেখে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে মেতে ওঠে নিষ্ঠুর খেলায়, জীবন তো তা-ই! জীবন এক অবিমিশ্র সংগ্রামের নামও। মানুষের জীবন নিয়েই গল্প লিখেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তার বেশিরভাগ গল্প অতি-কথন বিবর্জিত। তিনি নিজের আবিষ্কৃত একটি ভঙ্গি পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করেন অদ্ভুত কিছু শব্দ, কিছু সাধারণ লাইন যোগ করে। সেই লাইনটি গল্পটির যে শোভা বৃদ্ধি করে সেটি একেবারে অন্যরকম, বোধকরি বাংলা গল্পে এ স্টাইলটি তার একারই অধীন।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘নোলক’ গল্পের একটি লাইন, ‘কাজেম শেখের বাড়ি শিয়ালকোটে, যদি জানতে চান।’ ‘যদি জানতে চান’ একটি বাড়তি কথা। এ বাড়তি, সাধারণ কথাটিই পুরো বাক্যটির যে শ্রী-বৃদ্ধি করেছে সেটি গল্পের প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে তোলে।
নারী-পুরুষের কামনাবৃত্তির বিচিত্র গতি স্থান পেয়েছে ‘চৈত্রঘর’ গল্পে। আল মাহমুদ যেমন যৌনতার মধ্য দিয়ে তাবৎ জীবনকে ধরতে চেয়েছেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও গল্পে বারবার যৌনতার কাছে ফিরে গেছেন। ‘চৈত্রঘর’ মনে করিয়ে দেয় আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা’, ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পের কথা।
শহরের সঙ্গে গ্রাম জীবনের সমান্তরাল বাস্তবতায় বেড়ে ওঠা মইজুদ্দিনকে নিয়ে ‘চৈত্রঘর’। মইজুদ্দিন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব। গ্রামে বড় হয়েছেন, লেখাপড়ার জন্য পরে ঢাকা শহরে চলে যান। মা নেই, মইজুদ্দিন বড় হয়েছে সৎ মায়ের কাছে। সৎ মায়ের এক সৎ ভাইয়ের মেয়ে নাসিমাও ফুপুর বাড়িতে আশ্রিতা। যেখানে মইজুদ্দিনও থাকে। দুজনের বয়সের পার্থক্য এক বছরের। বয়ঃসন্ধির পরের সময়টায় শরীর উত্তাল, নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। মইজুদ্দিনের ছিল সেই উত্তাল অবস্থা। একদিন নাসিমাকে বাড়ির পুকুরে খোলামেলাভাবে আবিষ্কার করে মইজুদ্দিন। সেও নেমে পড়ে পুকুরে। এ দৃশ্য দেখে ফেলে মইজুদ্দিনের সৎ মা, নাসিমার সৎ ফুপু। শাস্তিস্বরূপ নাসিমাকে এক শিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, যে শিক্ষক আগে আরও দুটি বিয়ে করেছিল। অন্যদিকে মইজুদ্দিনকে নানা কৌশল খাটিয়ে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সেই যে মইজুদ্দিনের শরীর জেগেছিল, সে জাগরণ শরীরেই গুমড়ে মরেছে, গরল ঢেলে দেওয়ার জায়গা খুঁজে পায়নি মইজুদ্দিন। লেখাপড়া শেষ করে সে চাকরি পায়, পরে এক বিখ্যাত এমএনএর মেয়ে নাদিরা আঞ্জুমকে বিয়ে করে। শরীরের আবেগ মেটানোর বৈধ জায়গা খুঁজে পেয়ে মইজুদ্দিন যখন উত্তেজিত তখন দেখা গেল নাদিরার এসবে কোনো আগ্রহই নেই। নানা প্রতিরোধ তৈরি করে যৌন জীবনকে নাদিরা ক্রমাগত ভীতিকর করে তুলল। এর মধ্যেই তারা একটি পুত্র এবং একটি কন্যার পিতা-মাতা হয়ে যান। স্ত্রীর ওপর খুবই অল্প সময়ের যৌন দখলদারিত্ব বজায় রেখে দুই সন্তানের পিতা হওয়ার পর মইজুদ্দিন অনুভব করলেন তিনি বঞ্চিত, বুভুক্ষু, ক্ষুধা কাতর। তিনি অনুভব করলেন তার শরীরে চৈত্রের দাবদাহ। নাদিরা স্বামীকে চির-মঙ্গার দেশে একটি বাড়ি তৈরি করার অনুরোধ করে। স্ত্রীর দাবি মেটাতে উদ্যোগ নেন মইজুদ্দিন, এর মধ্যেই নাদিরা দেহত্যাগ করে। বাড়ি তৈরি হয়, বাড়ির নাম দেওয়া হয়, ‘চৈত্রঘর’।
এর পরই মইজুদ্দিনের পরিচয় হয় আলিমনের সঙ্গে। আলিমন বিধবা, আরেকজনের আশ্রয়ে থাকে। সকালের নাশতা পৌঁছে দিতে মইজুদ্দিনের কাছে তাকে আসতে হয়। আলিমনের ত্রিশ বছরের শরীরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে মইজুদ্দিন। মইজুদ্দিনের মনে হয় আলিমন এক রহস্য-ঘেরা মৃত্তিকা, অথবা ঘাসের চাদরে মোড়া মাঠ, আর তিনি সূর্য। সুতীব্র প্যাশনে আক্রান্ত হয় মইজুদ্দিন, কিন্তু আলিমন তাতে সায় দেয় না।
গ্রাম জীবনের বিশুদ্ধ রূপের বাইরে সংকীর্ণতা, কুসংস্কারের যে বিষ সেটি এ-গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, আলিমন মইজুদ্দিনের আহ্বানে সাড়া দিলে সে হয়তো তার আশ্রয়টিই হারাবে, এ বাস্তবতা বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রামকে ভিন্নভাবে অনুধাবন করায়। অভিমান বা কোনো রহস্যময় কারণে মইজুদ্দিন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। আলিমন আবার আসে চৈত্রঘরে। এসে দেখে মইজুদ্দিন নেই। আলিমন সেখানে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। গ্রামের মেয়ে আলিমন চৈত্র অনেক দেখেছে, কিন্তু চৈত্রঘরে বসে তার ঘোর লেগে যায়। তার শরীর টান দেয়। নিজের ভেতর অনুভব করে উত্তাপ, ছাই-চাপা আগুন যেন বেরিয়ে পড়তে চাইছে। আলিমনের নিজেকে মাটি মনে হয়, সে কামনা করে, ওপরের আকাশ যদি মাটিতে নেমে আসত! সূর্য নেমে আসত নিচে! লেখক লেখেন-
আলিমন কাঠের মেঝেতে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ে আকাশকে ডাকল। সূর্যকে ডাকল। বলল, আমি মাটি, আমাকে পোড়াও।
বিধবা আলিমনের ছিল সমাজের ভয়, শরীরের উত্তাপ নেভাতে মইজুদ্দিনকে নিয়ে সে দ্বিধায় ছিল। এখন, যখন প্রকৃতিকে সে কামনা করছে, শরীরের উত্তাপ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য প্রকৃতির জৈবশক্তির বিশালত্বকে যখন সে অস্বীকার করতে পারছে না, তখন প্রকৃতির সঙ্গে একজন নারীর আলিঙ্গনের অভিনব আকাঙ্ক্ষা পুরুষের প্রতি নারীর স্বাভাবিক যৌনবৃত্তির খণ্ডিত অর্থকে সংকুচিত করে তোলে।
‘নোলক’ গল্পটিও গ্রাম জীবনে পটভূমিকায় লেখা। এ-গল্পেও যৌনতার মধ্য দিয়ে জীবনকে ধরতে চেয়েছেন লেখক। ‘নোলক’ গল্পে আমরা খুঁজে পাই নানা ইশারা, ইঙ্গিত। খুঁজে পাই এক গভীর চিত্রকল্প।
বারই গ্রামের জ্যোৎস্না তার সৌন্দর্যের কারণে এলাকায় খ্যাত, আরেকটি পরিচয় তার আছে, সে খুব ভালো গান গায়, সে খোঁড়া, ছোটবেলায় পোলিওতে তার পায়ের এ অবস্থা হয়। জ্যোৎস্নার সঙ্গে স্থানীয় মকনের সম্পর্ক তৈরি হয়। যৌনতা মকনের জীবনে অমোঘ। লেখক বাঘের দাম্পত্য এবং যৌন জীবনের সঙ্গে মানুষের যৌনতার সংযোগ দেখিয়ে জ্যোৎস্নার সঙ্গে মকনের সম্পর্ককে চিহ্নিত করেন। জ্যোৎস্নাকে দেখলে মকনের শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে যায়, মকন জ্যোৎস্নাকে নিজের করে নিতে চায়। জ্যোৎস্নার চারপাশে অনেক ভক্তের দেখা মেলে, গানের গুরু মাক্কু শাহ জ্যোৎস্নাকে নাকে পরার একটি নোলক উপহার দেয়, জ্যোৎস্না সেই নোলক পরিধান করে। কিন্তু মকন এ নোলক পছন্দ করে না। এদিকে দুজনের মধ্যে যৌন সম্পর্কের জেরে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না চায় সন্তানের স্বীকৃতি, চায় বিবাহ, কিন্তু মকন এর কিছুই চায় না। সে ভ্রূণটা ফেলে দিতে চায়। সে এমনকি জ্যোৎস্নাকে বিয়েও করতে রাজি নয়। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স, যে রহস্যময়ী নারীর জন্য এমন ব্যাকুলতা, তাকে শরীরে কামনা করে কিন্তু জীবনে জড়াতে চায় না মকন। প্রেমকে একদিকে মহিমান্বিত করা আবার স্বীকৃতি না দেওয়া এবং তার সমাধান হিসাবে জটিল একটি পথ খুঁজে নেওয়ার উদ্যোগ গল্পটিকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। যেই পরিণতিতে জ্যোৎস্নার নাকের নোলক হয়ে পড়ে বড় অনুষঙ্গ। গল্পটিতে মকনের মাধ্যমে সামাজিক নির্যাতনের এক গভীর চিত্র ফুটে উঠেছে।
অনেক সময় সমাজের ওপরতলার মানুষদের অপরাধের বিচার হয় না, কায়দা করে তাদের অপরাধের দায় কীভাবে নিরপরাধ মানুষের ওপর পড়ে সেই বাস্তবতার শিল্পরূপের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এ তিন কাল অতিক্রম করে যার স্থিতি, যে ধর্ম সত্যস্বরূপ, তাকে বলে সত্য ধর্ম। সত্য ধর্মে মানুষ নিজের কর্মানুসারে আত্মপ্রসাদ বা আত্মগ্লানি ভোগ করে। ডিডেলাসের ঘুড়িতে লেখক বলেন, পৃথিবীতে সত্যধর্ম নাই। নাই বলেই হোসেন মিয়ার গ্যারেজের কর্মচারী ইমান ছুটির দিনেও ঘণ্টা তিনের মতো কাজ করে কোনো পারিশ্রমিক পায় না, এ সময় সে শখ করে ঘুড়ি ওড়ায়, ঘুড়িটা তাকে লুকিয়েই ওড়াতে হয় কারণ ইমানকে ঘুড়ি ওড়াতে দেখলে হোসেন মিয়া বলেন, ‘তুই একটা বাইচ্চা নাকি যে খালি গুড্ডি উড়াইবি? রাখ। গুড্ডি লাটাই রাখ। হাত লাগা। প্লাসটা খুইজ্যা দে।’ আবার পৃথিবীতে হয়তো সত্য ধর্ম আছে। নইলে নয় মাস বয়সে ইমান একইদিনে বাপ-মা দুজনকেই হারিয়েছিল। সেই ইমান বড় হলো কীভাবে!
একদিন ইমান গ্যারেজের কাজ সেরে ঘুড়ি ওড়াতে চলে যায়। ঘুড়িটা কান্নির অভাবে শুধু ডান দিকে কানাতে কানাতে মাঠের পাশের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের সঙ্গে থাকা নারিকেল গাছে আটকে গিয়েছিল। ইমান গাছ বেয়ে ঘুড়ি আনতে গিয়ে চারতলায় একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পায়। মেয়েটির ঊর্ধ্বাঙ্গে কাপড় নেই, সে ইমানের দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিতে চায়, বলে, ‘ভাই আমারে বাঁচাও। আমারে মাইর্যা ফেলতাছে।’
বারান্দার দরজাটি খুলে যায়। ইমান দেখে, ঢালকা বাজারের সবার চেনা দারোগা সাহেব উলঙ্গ মেয়েটিকে জাপটে ধরেছে। ব্যালকনিতে দারোগার স্ত্রীকে দেখা গেল। ইমান দেখল, তারা দুজনে মিলে মেয়েটিকে নিচে ফেলে দিতে।
ইমান সাংবাদিক মুয়ীদকে ঘটনাটির কথা বলল। মুয়ীদ আর সাবরিনা নীনা মিলে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করল। ধরা পড়ল দারোগা আর তার স্ত্রী।
কিন্তু সত্য ধর্ম আছে আবার নাই বলে, সত্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন দেখল রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট দারোগা ও তার স্ত্রী নয় মামলার নতুন চার্জশিটে দারোগা সাহেবের বাড়ির মূল্যবান জিনিস চুরির দায়ে ইমানকেই অভিযুক্ত করা হলো। সেই মৃত মেয়েটি, যার নাম আছমা। বলা হলো, ‘আছমা ওই পিচ্চি ইমানের সহযোগিতায় দারোগা সাহেবের ঘরের মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে পাচার করত। ছেলেটা গাছ বেয়ে উঠত, আর আছমা পোঁটলা চালান দিত।’ অকাট্য যুক্তি।
যেন কাম্যুর আউটসাইডারের নায়ক। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উদাসীনতা প্রদর্শন আর কান্না না করার কারণে সমাজের কাছে যে অপরাধী হয়ে যায়, খুনের মামলার দায় অনায়াসে তার ওপর চাপানো যায়, কারণ সে নির্মোহ, খুন সে করতেই পারে। ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’র ইমানের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক আরেক গরিব আছমার সঙ্গে যোগসাজশ করে দারোগার জিনিসপত্র চুরি করা। সমাজ এ গল্প গ্রহণ করতে প্রস্তুত। করেছেও।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প পড়ার অন্যতম আকর্ষণ, তিনি মানুষের আবেগকে তীব্রভাবে স্পর্শ করেন। তাই মুগ্ধতা প্রকাশই যথেষ্ট নয়, তার গল্পগুলো এত দাগ কাটে, বারবার পড়তে ইচ্ছা করে।
