নদী-ঝরনা-জলপ্রপাত প্রকৃতির এক অসাধারণ অনুষঙ্গ। মানববসতি গড়ে উঠেছে এই সুন্দর প্রকৃতি ঘিরেই। কিন্তু মানুষ এর ওপর অনাচার করেছে। শত শত বছর ধরে এর ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। বর্তমানে মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে কাজটি ঠিক হয়নি। নদী না থাকলে তাদের জীবন উপভোগ্য ও মসৃণ থাকবে না। ইউরোপে নদীকে জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো দেশে একে প্রাণের আলাদা অস্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আইন করা হয়েছে। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতও নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করেছেন। একে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে রক্ষণাবেক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন। বাস্তবে এখনো আমাদের নদ-নদী রক্ষায় কার্যকর কিছু করা যায়নি। প্রতিনিয়ত খবর আসছে, সারা দেশের নদীগুলোর অবস্থা করুণ। জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী জনপদের অধিবাসীদের বহুবিধ উপকারে এসেছে। সেজন্য বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ।
মাছে ভাতে বাঙালি-এ প্রবাদটির মূল কারণ এই নদী। এ অঞ্চল ছিল অফুরন্ত মাছের ভাণ্ডার। শুষ্ক মৌসুমে ফসলের জন্য পানির উৎস ও যোগাযোগের সহজ মাধ্যম নদী। এখন প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশিত হচ্ছে, নদী মরে যাচ্ছে। এ কারণে মরুকরণের পথে চলেছে দেশ। এর পেছনে আমাদের সীমাহীন লোভ-লালসা একদিকে দায়ী; অন্যদিকে দায়ী প্রতিবেশী দেশের পানি প্রত্যাহার। প্রভাবশালীরাও যেখানে পারছে নদী দখল করছে। নদীর উপর নির্মাণ করছে অবৈধ স্থাপনা। কোথাও নদীতে সরাসরি বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি করা হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
আরেকদিকে চলছে ভয়াবহ দূষণ। কলকারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য ও শহরের পয়ঃনিষ্কাশন হচ্ছে সরাসরি নদীতে। বহু নদীতে পানি থাকলেও এখন আর কোনো মাছ নেই। এসব নদীর পানি ব্যবহার দূরের কথা, রাসায়নিকের প্রভাবে অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদও নদীতে টিকতে পারছে না। এগুলো রক্ষায় আইনের অভাব নেই, কিন্তু এর সফল প্রয়োগ দেখা যায় না।
ছোট ছোট নদী নিয়ে কথা বলার কোনো আগ্রহ আমাদের যেন নেই। সরকারি হিসাবে নদ-নদীর সংখ্যা ৭০০ থেকে কমে এখন ৪০০ হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে নদীর সংখ্যা ছিল দেড় সহস্রাধিক, এখন তা ২৫০। দেশের আনাচে-কানাচে থাকা ৫৫০টি নদী বিলীন হয়ে গেছে। প্রধান নদীর মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক। নদ-নদীর অবস্থা কেমন তা নৌপথের বর্তমান অবস্থা থেকে অনুমান করা যায়। স্বাধীনতার পরপর বিআইডব্লিউটিএ’র এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র সাত হাজার কিলোমিটারে। পরিবেশবাদীদের হিসাবে গত চার দশকে ৫০ থেকে ৮০টি নদী, শাখা ও উপনদী বিলীন হয়ে গেছে। এর প্রভাব সরাসরি নদীর পাড়ের জনবসতিতে পড়েছে। এর ওপর নির্ভরশীল জেলে ও কৃষকরা হয়েছে বিপন্ন। মানুষ বঞ্চিত সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ থেকে। সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। এভাবে নদী ধ্বংসের মূল উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। দখল ও দূষণ রোধে সামান্য কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়। সেগুলো যে প্রভাবশালীদের সঙ্গে পেরে ওঠে না, তা প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নদীর পানি হিস্যা আদায়ে সরকারের কোনো জোরালো উদ্যোগ বিগত এক যুগে দেখা যায়নি। আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে নদীগুলোর রয়েছে বিশেষ অবদান। তাই নদ-নদীগুলো আমাদের দেশ ও জাতির স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদীগুলোর নাব্য ধরে রাখার জন্য গ্রহণ করতে হবে যুগোপযোগী ও কার্যকর ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ।
মো. লোকমান হেকিম
hrahmansyl76@gmail.com