একান্নবর্তী পরিবার ও আজকের বৃদ্ধাশ্রম
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবী পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন এসেছে দেশ, সমাজ, পরিবার, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ব্যক্তি, মানসিকতা, বিবেকবোধ ও রুচির। এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতায়। উন্নয়ন হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির। সব কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমরাও নিজেদের তৈরি করছি, প্রস্তুত হচ্ছি। সেই প্রস্তুতির অংশ উঠে এসেছে শিক্ষার প্রসার। আগের তুলনায় শিক্ষার হার এখন বেশি। আগে সারা গ্রাম বা মহল্লা ঘুরে এক বা দুজন শিক্ষিত লোক পাওয়া যেত। এখন অধিকাংশ পরিবারের প্রায় সবাই শিক্ষিত। ছেলেমেয়ে কেউ পিছিয়ে নেই। লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করছে তারা। পরিবর্তন করছে নিজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার।
প্রযুক্তির কারণে এখন জীবন সহজ হয়েছে ঠিকই; কিন্তু সেই সহজ জীবনকে আরও সহজ ও ঝামেলামুক্ত রাখার জন্য একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে তৈরি হয়েছে একক পরিবার। যেখানে সবাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। তবে এ শিক্ষার মাঝে কোথাও বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে, মানুষ আধুনিক হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, বিনিময়ে হারিয়ে ফেলছে মনুষ্যত্ব, মানবতা। একক পরিবার মানেই যেন স্বামী স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে পরিবার। এর বাইরে কাউকে পরিবারের লোক হিসাবে মানা বা গ্রহণ করার মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে অধিক শিক্ষিত হয়েও, অনেক অর্থের মালিক হয়েও মা-বাবার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলের মস্তবড় ফ্ল্যাট থাকলেও সেখানে জায়গা হয় না বৃদ্ধ মা-বাবার। অথচ এ মা-বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনায় তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মা-বাবার স্বপ্ন থাকে ছেলে বড় হয়ে শিক্ষিত হয়ে ভালো চাকরি বা ব্যবসা করবে তখন তাদের দুঃখ লাঘব হবে। তারা শেষ বয়সে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাবে; কিন্তু বর্তমান দৃশ্য তার উলটো। শিক্ষিত বড়লোক ছেলের সামনে দাঁড়াতে পারেন না অধিকাংশ বাবা-মা। বয়সের ভারে যখন তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন তখন তারা মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েন। এ বয়সে তারা পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্যে থাকতে চান। বিশেষ করে নাতি-নাতনিদের নিয়ে হেসে খেলে সময় কাটাতে চান তারা। ঘুম থেকে উঠে প্রিয় সন্তানের মুখটা একবার দেখতে চান। এর বেশি চাওয়া তাদের নেই বোধহয়। সেই সামান্য চাওয়া সন্তানরা পূরণ করতে ব্যর্থ আজ। বৃদ্ধাশ্রমে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে পরপারে যাত্রা করতে হচ্ছে গর্ভধারিণী মা ও জন্মদাতা বাবাকে।
শিক্ষায় যে ঘাটতিটা রয়ে গেছে সে কারণে সন্তানের বিবেকবোধ জাগ্রত হচ্ছে না। তথাকথিত এ শিক্ষিত সমাজের বোধোদয় হোক। মা-বাবা আমাদের মাথার ওপর অনেক বড় ছাঁয়া। বটবৃক্ষ যেমন ডালপালা দিয়ে ছাঁয়া দিয়ে রোদ তাপ থেকে বাঁচায় আবার শিকড় দিয়ে আটকে রাখেন মাটির সঙ্গে যাতে কোনো ঝড় সহজে ভাঙতে না পারে, তেমনি বয়স্ক মানুষগুলো আগলে রাখেন পরিবারের সবাইকে। নিজের হাতে সে ছাঁয়া সরিয়ে দেওয়া নিতান্তই বোকামি। মনে রাখতে হবে আপনিও বাবা, আপনিও মা। বৃদ্ধ আপনারাও হবেন একদিন।
নূরজাহান নীরা
চিকিৎসক ও লেখক, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ