
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৭ এএম
প্রাক-বর্ষার বজ্রপাতে তাণ্ডব বেশি
বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে অ্যাপভিত্তিক নতুন উদ্যোগ
‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ উন্নততর করা * মেসেজ, কমিউনিটিনির্ভর ভলান্টিয়ার ব্যবস্থা

হক ফারুক আহমেদ
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
বজ্রপাতে প্রতিবছর দেশে ৩০০ জনের বেশি মারা যান। সারা বছর বজ্রঝড়ের প্রকোপের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বজ্রপাত হওয়ার সময়কে সাধারণত দুইটি সময়ে বিভাজন করা হয়ে থাকে। একটি প্রাক-বর্ষাকাল এবং অন্যটি বর্ষাকাল। মার্চ-মে প্রাক-বর্ষাকাল সময়ে ৩৮ শতাংশ বজ্রঝড় হয়ে থাকে। অন্যদিকে জুন-সেপ্টেম্বর বর্ষাকালে ৫১ শতাংশ বজ্রঝড় হয়। আর ৯ ভাগ বজ্রঝড় হয় অক্টোবর ও নভেম্বরে। ২ শতাংশ হয় ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারিতে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গড়ে ৩৮ শতাংশ বজ্রঝড় তৈরি হলেও তাণ্ডব, ধ্বংস এবং বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হারের দিক থেকে প্রাক-বর্ষাকালই সবচেয়ে ভয়াবহ। আর তাই এ সময়েই সবচেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বজ্রপাতজনিত সতর্কতা প্রদান, আবহাওয়ার বিভিন্ন বিষয় প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে অ্যাপভিত্তিক বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, মাস হিসাবে বেশি বজ্রঝড় হয় মে মাসে, গড়ে ১৩ দিন। এপ্রিলে ৯ দিন এবং মার্চে ৫-৬ দিন। সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রঝড় এপ্রিল ও মে মাসে হয়ে থাকে। এর সঙ্গে থাকে দমকা বাতাস এবং ঝড়ো হাওয়া; কখনো কখনো শিলাবৃষ্টি। দেশের অভ্যন্তরে রাজশাহী, রংপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয়ে থাকে। তাণ্ডবতাও বেশি হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশকিছু এনজিওর সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। অ্যাপের মাধ্যমে দেশের আবহাওয়ার যাবতীয় বিষয়সহ আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম কীভাবে জনগণের দৌরগোড়ায় পৌঁছানো যায়, সে বিষয়ে কাজ করছি আমরা। ভয়েস মেসেজ, কমিউনিটি বেইজড ভলান্টিয়ারের মাধ্যমে কীভাবে দ্রুত খবর পাঠানো যায়, সে বিষয়ে কাজ করছি। অল্প সময়ের মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টাওয়ারভিত্তিক সতর্কতামূলক প্রোগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এসব উদ্যোগ কার্যকর করা গেলে আবহাওয়ার সার্বিক দিকসহ, বজ্রপাত, ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। কমিয়ে আনা যাবে প্রাণহানি।
জানা যায়, দেশে বজ্রঝড় তৈরি হয় নানাভাবে। অভ্যন্তরে একটি মেঘ থেকেই বজ্রঝড় তৈরি হতে পারে। আবার কয়েকটি বজ্রমেঘ পাশাপাশি তৈরি হয়ে একত্রিত হয়ে স্ক্রল লাইন গঠন করে শক্তিমাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ডে বজ্রমেঘ তৈরি হয়ে বাংলাদেশের সিলেটে প্রবেশ করেও তান্ডবতা চালাতে পারে। এটিকে বলে ট্রান্সবাউন্ডারি বজ্রঝড়। পশ্চিমবঙ্গের বিহার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পরিপক্বতা লাভ করেও বজ্রঝড় হয়ে থাকে। এছাড়াও নেপাল বা ভুটানের মাঝখানে তৈরি হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। যে ধরণেরই হোক না কেন, এসব বজ্রঝড়ের তাণ্ডব এবং এর ফলে সংশ্লিষ্ট শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশে এই বজ্রঝড়ের আয়ুষ্কাল আধা ঘণ্টা থেকে বড়জোর দুই ঘণ্টা হতে দেখা যায়। এ সময়ের মধ্যেই এই ঝড় তৈরি হয়ে তার তাণ্ডব চালায়। যদি প্রান্তিক পর্যায়ের চাষি, মৎস্যশিকারি থেকে খোলা জায়গায় কাজ করা মানুষকে বজ্রমেঘ চেনানো যায় এবং সতর্কতা অবলম্বন করা যায়, তাহলে বজ্রপাতে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
বজ্রমেঘ চেনার উপায় হিসাবে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব (ঈশান কোণ) বা উত্তর-পশ্চিম কোণে যদি বিশাল উচ্চতাবিশিষ্ট (টাওয়ারিং ক্লাউড বা কিউমুলোনিম্বাস ক্লাউড বা থান্ডার ক্লাউড) তৈরি হতে থাকে এবং ওপরের দিকে এর উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন বুঝতে হবে এই মেঘ গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা। এই মেঘমালা ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮-১২ কিলোমিটার, কখনো কখনো ১৮-২২ কিলোমিটার ওপরের দিকে ধাবিত হতে পারে। এ ধরনের মেঘমালা তৈরি হলে এর তাণ্ডবতা সবচেয়ে বেশি থাকে। এর সঙ্গে কখনো কখনো থাকে শিলাবৃষ্টি, দমকা বাতাস ও ঝড়ো হাওয়া। হয় বজ্রপাত। এ সময় যারা খোলা মাঠে কাজ করেন, গাছের নিচে অবস্থান করেন বা জলাধারে মাছ ধরেন, তারা সবচেয়ে উঁচু লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বজ্রপাতে মারা যান।
বজ্রপাতের সময় থার্টি বাই থার্টি বিধি অনুসরণ করতে হবে। বজ্রপাতের সময় আলোর বিচ্ছুরণ দেখামাত্র গণনা শুরু করতে হবে। এভাবে ৩০ পর্যন্ত গণনার সময়ে যদি শব্দ শোনা যায়, তাহলে মনে করতে হবে বজ্রঝড় অতি নিকটে। এ সময় অন্তত ৩০ মিনিট ঘরে অবস্থান করতে হবে।
খোলা মাঠে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসাতে হবে আরও বেশি। মসজিদ বা মন্দিরকেন্দ্রিক আর্থিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে বেশি বেশি। কারণ, মিনারগুলো উঁচু হয়ে থাকে। বজ্রপাতের আগে, বজ্রপাতের সময় এবং বজ্রপাতের পরে সতর্কতামূলক বিষয়গুলো বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।