
প্রিন্ট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০০ পিএম
সংবাদ সম্মেলনে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান
দশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল
তাৎক্ষণিক বিনিয়োগ ৩১০০ কোটি, সম্মেলনে খরচ ৫ কোটি টাকা * ঢাকা বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল দ্রুত চালু এবং বন্দরগুলোকে সচল করার উদ্যোগ

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
একশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১০টি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৫টি সরকারি এবং ৫টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এছাড়া ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল দ্রুত চালু এবং বাংলাদেশের বন্দরগুলোকে সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণে বন্দর দ্রুত চালু হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) যৌথ মিটিংয়ে রোববার এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মিটিং শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে দুই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এসব তথ্য জানান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম এবং বিডার হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নাহিয়ান রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সম্প্রতি ভারত সরকার বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। এছাড়া রোববারের বৈঠকে আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে-নেপালের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, চট্টগ্রাম বন্দরের কাজে গতি আনতে দ্রুত বে-টার্মিনাল চালু। এ সময়ে ৭-১০ এপ্রিল বিডা আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খরচ ১ কোটি ৪৫ লাখ এবং সহযোগীদের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। সম্মেলনে তাৎক্ষণিকভাবে দুই প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গুরুত্ব বিবেচনায় রোববারের বৈঠকে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল করা হয়েছে। বাতিল করা সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারের সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক, বাগেরহাটের সুন্দরবন ট্যুরিজম পার্ক, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, গাজীপুরের শ্রীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বেসরকারি মালিকানায় থাকা ৫টি অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর মালিকানায় মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্টস শিল্প পার্ক, সুনামগঞ্জের ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাগেরহাটের ফমকম অর্থনৈতিক অঞ্চল, ঢাকার সিটি স্পেশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চল। আশিক চৌধুরী বলেন, এছাড়াও নেপালের জন্য আলাদা একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঘোষণা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৯৭টির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬৮টিই ছিল সরকারি।
বিডার চেয়ারম্যান বলেন, আগামী অক্টোবরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু করার কথা ছিল। এটি কত দ্রুত চালু করা যায়, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়াও অন্যান্য বিমানবন্দর সচল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দর, সিলেট বিমানবন্দর এবং লালমনিরহাট বিমানবন্দর অন্যতম। তিনি বলেন, দেশের আটটি এজেন্সি বর্তমানে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন ড. ইউনূস। বর্তমানে এর কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে যারা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয় সরকার। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তাদেরও একরকম প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশিক চৌধুরী বলেন, বর্তমান বিডায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু রয়েছে। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে অনেক সেবা পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে কোনোটি ম্যানুয়াল এবং কোনোটি ডিজিটাল। এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ম্যানুয়াল ও ডিজিটাল দুটি সেবাই রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোয় এক মাসের মধ্যে ম্যানুয়াল সেবা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। অর্থাৎ, সব সেবা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল প্রকল্প চালুর উদ্যোগ ছিল। এটি কত দ্রুত চালু করা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এটি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা আছে। তবে আমি মনে করি, এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এর বিকল্প হিসাবে আমরা বাংলাদেশি বন্দরগুলো চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়াও এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে দুবাইভিত্তিক জায়ান্ট কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। তাদের সহায়তায় বাংলাদেশে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল স্থাপনের চিন্তা করছে সরকার। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তবে এতে পার্টনার হিসাবে যারা অংশ নিয়েছেন, তারা ব্যয় করেছেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চারদিনের এ সম্মেলনে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। তবে খরচের হিসাব দিয়ে সম্মেলনকে মূল্যায়ন করা যাবে না।
বিনিয়োগের সব ক্রেডিট এই সামিটের নয়। এটা আগে থেকে চলতে থাকা আলোচনার ভিত্তিতে হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা সম্মেলনে এসেই বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে দেবেন, বিষয়টি এমন নয়। তাই এটিকে সামিটের সফলতা হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। সামিটের খরচ দিয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বিচার করলে হবে না। এখানে ৬টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। নাহিয়ান রহমান বলেন, এবারের সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। সম্মেলনের উদ্বোধনের দিন মোট অংশগ্রহণকারী ছিল ৭১০ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এবার ৫০টি দেশ থেকে ৪১৫ জন বিদেশি ডেলিগেট অংশ নিয়েছেন। বাকি ৩৯৫ জন দেশি বিনিয়োগকারী। অর্থাৎ সংখ্যার দিক থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ৫৮ শতাংশ। তবে চারদিনের অনুষ্ঠানে সাড়ে ৩ হাজার ব্যক্তি অংশ নেন। এর মধ্যে প্যানেলিস্ট ছিলেন ১৩০ জন। সামিটে ১৫০টি অফিশিয়াল মিটিং হয়েছে। তার মতে, দেশের মানুষের সহনশীলতা, বিনিয়োগ সম্ভাবনার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে বিদেশিরা উচ্ছ্বসিত। তার মতে, সামিটের সফলতা নিয়ে বিডা চিন্তিত নয়। বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরাই ছিল সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এর চেয়েও ভালো সামিট করা যেত। সেটা হতেই পারে। এবারের আয়োজন কতটা সফল হয়েছে, তা সময়ই বলে দেবে। কারণ, সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের ধারণা বদলানো। সামিটে অংশ নেওয়ার পর যে ধারণা নিয়ে তারা ফেরত গেছেন, তা আমাদের জন্য খুবই ইতিবাচক। কেননা বাংলাদেশকে জানার জন্য গুগলে তথ্য খুঁজলে তারা যা জানতে পারে, সশরীরে এসে যা দেখেন, তা পুরোটাই বিপরীত। অনুষ্ঠানে আরও জানানো হয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে বিডা। বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সরেজমিন তুলে ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোই এই আয়োজনের উদ্দেশ্য।
রাজনৈতিক দলগুলো পলিসির ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হলো কমন এজেন্ডা। সব সরকারই এটা চাইবে। সব রাজনৈতিক দলও সেটাই চাইবে। সেজন্য আমরা এই সামিটে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পদের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। যারা প্রথমবার এসেছিলেন, তারা দেশটাকে জেনে গেছেন। তারা বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে একটা নেগেটিভ ও ন্যারেটিভ প্রচারণা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বন্যা, খরা আক্রান্ত গরিব দেশ। কিন্তু তারা তো এসে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন।