
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০১ এএম
ফতুল্লায় শুয়ে আছেন আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী

যুগান্তর প্রতিবেদন, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় শায়িত আছেন বহু বিদ্যাবিশারদ ও উদ্ভাবক, দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী। কালের বিবর্তনে তার সব পরিচয় মুছে গেছে। তিনি এখানে ভক্তদের কাছে একজন পির। তার হাত দিয়েই সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সৌরবর্ষপঞ্জির বাংলা বর্ষ প্রচলন করেন। সৌরবর্ষপঞ্জিকায় গরমিল থাকায় সম্রাট আকবর তার অস্থাভাজন ইরানের সিরাজ থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে হিজরি চান্দ্রবর্ষপঞ্জিকাকে সৌরবর্ষপঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার দায়িত্ব দেন। প্রায় ৪৪১ বছর আগে বাংলায় পদার্পণ করেন ইরানের বাসিন্দা আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী। তিনি তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগরের পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে যেটা বর্তমান নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আস্তানা গড়ে তোলেন। কথিত আছে তিনি জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি ইসলাম ধর্মও প্রচার করেন। এলাকার অনেক মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করান। তাকে ঘিরেই এ এলাকার নাম পরিচিতি পায় শাহ ফতেহউল্লাহ। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমির ফতেহউল্লাহ থেকে এটি মানুষের কাছে হয়ে ওঠে ফতুল্লা।
মূলত হিজরি সনে অগ্রহায়ণ ছিল বর্ষের প্রথম মাস। অগ্রহায়ণের আগের মাস ছিল কার্তিক, যা ছিল মরা কার্তিক হিসাবে পরিচিত। অর্থাৎ বর্ষার শেষ সময়। অনেক সময় বর্ষায় কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যেত। বন্যা নেমে যাওয়ার পর মাঠঘাট থাকত কাদাজলে মাড়ানো। এসব কারণে অগ্রহায়ণ মাসে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় খাজনা পাওয়া যেত না। কৃষক বা ব্যবসায়ীরা পূর্ণাঙ্গ খাজনা দিতে পারতেন না। এসব বিবেচনা থেকেই হিজরি চান্দ্রবর্ষপঞ্জিকাকে সৌরবর্ষপঞ্জিকায় রূপান্তর করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি গবেষণা করে বৈশাখ মাসকে নববর্ষ করে সম্রাট আকবরের কাছে বাংলাসনের বিস্তারিত পেশ করেন। সম্রাট আকবর তা অনুমোদন দিয়ে প্রচলন করেন।
ফতুল্লায় বসবাসকারী ঢাকার কেরানীগঞ্জের পারজোয়ার ব্রাহ্মগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত বাংলার শিক্ষক ও সাংবাদিক রঞ্জিত মোদক বলেন, আমরা শাহ ফতেহউল্লাহকে একজন পির হিসাবে জানি বা ভক্তি করে আসছি। কিন্তু তিনি যে একজন সাহিত্যিক, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী বা জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর পাণ্ডিত ছিলেন, সেটা কালের পরিক্রমায় ঢাকা পড়ে গেছে। তাকে নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। কারণ, তিনি বাংলা নববর্ষের উদ্ভাবক ছিলেন। বাংলা নববর্ষ আজ বাংলাদেশ, ভারতের কলকাতাসহ বাংলা ভাষাভাষী কোটি কোটি মানুষ পালন করে। এ সবই আমির শাহ ফতেহউল্লাহ সিরাজীর কারণে। কিন্তু আমরা তাকে স্মরণ করি না। তিনি বলেন, সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে তার জীবনচিত্র গবেষণা করে বই বের করে নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দাবি জানাই।
ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ বলেন, পির শাহ ফতেহউল্লাহর নামেই এ অঞ্চলের নাম পরিচিত ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে ধীরে ধীরে ফতেহউল্লাহ থেকে এটি ফতুল্লায় রূপান্তর হয় বলে পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি। তিনি একজন ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, তিনি বাংলা নববর্ষের উদ্ভাবক।
ফতুল্লার চৌধুরিবাড়ির সদস্য হান্নান চৌধুরি বলেন, আমাদের পাঁচপুরুষ আগে ছিল বিকে দাম পরিবার। শাহ ফতেহউল্লাহ ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলায় এসে এই ফতুল্লায় আগমন করেন। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী আমাদের এখানেই আস্তানা গড়ে তুলেন। তিনি বলেন, আমির ফতেহউল্লাহ ছিলেন সম্রাট আকবরের নবরত্নের একজন। রাজদরবারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাকে আমিরুল মুল্ক, আসাফুদৌলা, রোস্তমসানী ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সিটি অব ঢাকা বইয়ে শাহ ফতেহউল্লাহর জীবনী বর্ণনা আছে।
তিনি বলেন, বর্তমান শাহ ফতেহউল্লাহর যে মাজারটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটি তার ওফাতের অনেক পরে গড়ে উঠেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের একজন স্বপ্নে দেখেন এ জায়গার গাছ যেন কাটা না হয়। সেখানে একজন অলির কবর আছে। পরবর্তীকালে জায়গাটি চিহ্নিত করে মাজার গড়ে তোলা হয়।
মাজারের খাদেম মোস্তাক আহমেদ সুমন বলেন, সাত শতাংশ জমির ওপর শাহ ফতেহউল্লাহ, তার স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শ্বশুরের সমাধি নির্মত হয়। প্রতিবছর ১৩ জিলকত আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বার্ষিক উরস অনুষ্ঠিত হয়। এ তারিখেই তিনি ওফাত করেন বা অন্তর্ধানে যান। সুমনা আরও বলেন, গবেষক আবুল ফজল আকবরনামা বইয়ে আমির ফতেহউল্লাহ সম্পর্কে লিখেছেন। ওই বইয়ে তার ওফাতের তারিখ উল্লেখ আছে। তিনি বলেন, প্রতিবছর উরসের সময় ঢাকার নবাববাড়ির সদস্যরা এসে অংশ নেন এবং মাজারে চাদর বা গিলাফ চড়ান। সুমন বলেন, ১৯৭২ সালে আমি ফতেহউল্লাহ মাজারের টাকায় গড়ে ওঠে পার্শ্ববর্তী শাহ ফতেহউল্লাহ ইসলামিক দাখিল মাদ্রাসা। মাদ্রাসটি দীর্ঘদিন মাজারের টাকায় পরিচালিত হয়।
তবে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তি রফিউর রাব্বি বলেন, ফতুল্লার পির শাহ ফতেহউল্লাহ আর বাংলা নববর্ষের আবিষ্কারক আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী এক ব্যক্তি নন।