
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১৮ এএম

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ হলো। ট্রাম্প প্রশাসনের ট্যারিফ প্ল্যান, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ এবং ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্প যখন ব্যাপক চাপে আছে, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ শিল্পের জন্য আত্মঘাতী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দেশি বিনিয়োগের চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগকে বেশি প্রাধান্য দিতে চাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দেশীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ না বাড়ালে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। কারণ, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাই প্রতিটি দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। সরকার হয়তো শিগ্গিরই অনুধাবন করতে পারবে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ী নেতারা রোববার যুগান্তরকে এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বর্তমানে গ্যাসের যে দাম আছে, সেই দামই শিল্পের জন্য উপযুক্ত নয়। তারপরও নতুন সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মানে, সরকার চাচ্ছে না দেশে শিল্পায়ন হোক, উৎপাদন বাড়ুক। আমরা বিইআরসির শুনানিতে গ্যাসের দাম কমানোর একাধিক যুক্তি তুলে ধরেছিলাম; কিন্তু এর একটাও আমলে নেওয়া হয়নি।
একতরফাভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের ট্যারিফ, এলডিসি উত্তরণের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্প এমনিতে চাপে আছে। ঋণ বিতরণ প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকারই চাইছে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা কমে যাক। এ সিদ্ধান্তের ফলে নতুন বিনিয়োগ আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
পারভেজ বলেন, সরকার দেশীয় শিল্পের চেয়ে সামান্য ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বেশি আগ্রহী। আইএমএফ-এর শর্ত মেনে জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে দিলে একে একে সব শিল্প বন্ধ হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না বাড়লে তখন আইএমএফ-এর কাছ থেকে নেওয়া ঋণ সরকার কীভাবে পরিশোধ করবে।
নিট পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবে না। বিদ্যমান রেটেই শিল্প হিমশিম খাচ্ছে। মাসের পর মাস গ্যাস বিল দিতে পারছেন না শিল্পের মালিকরা। তিনি আরও বলেন, আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশনে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এটা অতীতেও বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সরকার কেন গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল, সেটি বোধগম্য নয়। সরকার নিজেই যেখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, বিনিয়োগ সামিট করে বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, সেখানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, দেশে পর্যাপ্ত গ্যাস মজুত রয়েছে; কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনো নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নেয়নি। এর পরিবর্তে সরকার এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা মূলত একটি অলিগার্ক শ্রেণিকে লাভবান করেছে। আগের সরকারও এ পথেই হেঁটেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি দেশের শিল্প খাতকে ধ্বংস হতে দেবে নাকি এগুলোকে রক্ষা ও উন্নয়নে পদক্ষেপ নেবে?
তিনি আরও বলেন, আগের সরকার অনেক খাতে, বিশেষ করে জ্বালানিতে ভারতের ওপর উচ্চমাত্রার নির্ভরতা তৈরি করেছে। আমরা সেই নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছি। কারণ, ভারত কখনোই উভয় পক্ষের জন্য উপকারী (উইন-উইন) দ্বিপাক্ষিক বা কূটনৈতিক সম্পর্কে বিশ্বাস করে না। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে রাসেল বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে এ মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। বিপিসি, তিতাস এবং এ ধরনের সংস্থাগুলো মুনাফাভিত্তিক মানসিকতা নিয়ে চলছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রম থেকে ভোক্তা না শিল্প খাত উপকৃত হচ্ছে। বরং এখন গ্যাসের দাম কমিয়ে আনতে হবে প্রায় ২০ টাকার মধ্যে।
রাসেল আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা অসম্ভব। কিন্তু আমরা যখন বারবার গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছি, তখন বিনিয়োগকারীরা কীভাবে আসবে? এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত করবে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, সরকারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশীয় বিনিয়োগ আর লাগবে না। বিদেশি বিনিয়োগ হলেই চলবে। তাই সব মনোযোগ বিদেশি বিনিয়োগের দিকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব বিনিয়োগকারীই বিনিয়োগের আগে মুনাফার হিসাব কষেন, বিনিয়োগ পরিবেশ ও নীতির ধারাবাহিকতা আছে কি না, সেটা খেয়াল করেন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের নতুন বিনিয়োগ তো হবেই না, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ইতোমধ্যে ট্রাম্পের শুল্কারোপের সুবিধা কাজে লাগাতে বিভিন্ন দেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের অফার দিচ্ছে। আর আমরা উলটো আইএমএফ-এর পরামর্শে গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছি।