
প্রিন্ট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪০ পিএম
ইন্টারপোলকে প্রসিকিউশন
দশজনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির চিঠি
রয়েছেন ওবায়দুল কাদের আসাদুজ্জামান খান ও হাছান মাহমুদ * অভিযোগ জমা পড়ে ৩৩০টি তদন্ত চলছে ৩৯টি মামলার * হাসিনাসহ অভিযুক্ত ১৪১, গ্রেফতার ৫৪, পলাতক ৮৭ জন * গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্টের অপচেষ্টা

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
জুলাই গণহত্যা মামলার পলাতক আসামি সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ’ জারির চিঠি দিয়েছে প্রসিকিউশন। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ তথ্য দেন। এ সময় সাংবাদিকদের জানানো হয়, ট্রাইব্যুনালের অনেক তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। পরোয়ানা জারির আগেই আসামির কাছে তথ্য চলে যাচ্ছে। গোপন বন্দিশালা আয়নাঘরে পাঁচটি বোমায় টাইমার সেট করে রাখা হয়েছিল। যেগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টদের হত্যার পরিকল্পনা ছিল। পতিত সরকারের আজ্ঞাবহরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্টের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করেছে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। এদিকে জুলাই-আগস্টে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে’ এ পর্যন্ত ৩৩০টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে ২২টি মিস কেস দায়ের হয়। তদন্ত শেষ হয়েছে চারটি মামলার। এসব মামলায় ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত হয়েছেন ১৪১ জন। এর মধ্যে গ্রেফতার ৫৪, আর বাকি ৮৭ জন পরোয়ানা নিয়ে পলাতক। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করতে ২২ ডিসেম্বর চিঠি দিয়েছে প্রসিকিউশন। শেখ হাসিনার ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির বিষয়ে আপাতত কোনো তথ্য নেই বলে গতকাল জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের সঙ্গে দুপুরে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। সেখানে এসব তথ্য দেওয়া হয়। ইন্টারপোলে দেওয়া দশজনের মধ্যে অন্যরা হচ্ছেন-একেএম মোজাম্মেল হক, হাছান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, ড. এ আরাফাত, শেখ ফজলে নূর তাপস, তারিক আহমেদ সিদ্দিক, নসরুল হামিদ বিপু এবং মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
মতবিনিময়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আজ চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটু আগে এটা (নথিপত্রসহ চিঠি) আমরা পাঠিয়েছি। এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বিষয়ক আপডেট প্রতিবেদন তুলে ধরেন প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া গোপন বন্দিশালায় বোমা রাখার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আয়নাঘর’ গোপন বন্দিশালা নিয়ে যারা তদন্ত করছেন, তাদের হত্যার জন্য সেখানে আগে থেকেই বোমা রাখা হয়েছিল। পাঁচটি বোমার সঙ্গে টাইমার সেট করা ছিল। সেগুলো বিস্ফোরিত হলে পুরো ভবনটি উড়ে যেত। বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করার পরই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখানে পরির্দশনে যান।
চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর অভিযোগ আনার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত আইনজীবী ফার্ম ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতভাবে তদন্ত কার্যক্রম ও প্রসিকিউটরদের সম্পর্কে গুজব, ভুল তথ্য, মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে জনমনে, বিশেষ করে জুলাই শহিদ পরিবারের সদস্যদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। মতবিনিময় সভায় প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার, মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাইমুম রেজা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভার শুরুতে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেড় হাজারের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। ২৫ হাজারের মতো ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। সব ঘটনার জলজ্যান্ত প্রমাণ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে আমরা সেটা প্রমাণ করতে সক্ষম হব। ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ’ জারির প্রক্রিয়া তুলে ধরে তিনি বলেন, কোর্টের (আদালত) আদেশ এবং আমাদের চিঠিসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইজিপি অফিসে এসংক্রান্ত আলাদা সেকশন আছে। সেখান থেকে এটা ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো হয়। এই ১০ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশের জন্য সব ডকুমেন্টস তৈরি করে আমাদের অফিস থেকে আইজিপি (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) অফিসে পাঠানো হয়েছে। তারা সেখান থেকে যথানিয়মে ইন্টারপোলের কাছে পাঠাবেন।
প্রসঙ্গত, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির অর্থ হলো-ওই ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও বিচার বিভাগ বিচারের মুখোমুখি করতে অথবা দণ্ড কার্যকরের জন্য খুঁজছে। সদস্য দেশগুলো ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতক আসামির সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে এবং সে দেশের সরকার তা খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে।
অভিযোগ জমা পড়ে ৩৩০টি, তদন্ত চলছে ৩৯টি মামলার : বৃহস্পতিবার মতবিনিময় সভায় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্য ও তদন্ত কার্যক্রমের ওপর তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ’র এ পর্যন্ত ৩৩০টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়ে। এর মধ্যে ৩৯টি মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে ২২টি মিস কেস দায়ের হয়। তদন্ত শেষ হয়েছে চারটি মামলার। এগুলো হলো-আইসিডি বিডি মিস কেস নং- ০৮/২০২৪ (আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানোর ঘটনা), আইসিডি বিডি মিস কেস নং-০১/২০২৫ (চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা), আইসিডি বিডি মিস কেস নং-০৭/২০২৫) (রামপুরা কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলির ঘটনা) ও আইসিডি বিডি মিস কেস নং-০২/২০২৪ (শেখ হাসিনা)।
বন্দিশালায় পাঁচটি বোমা ও টাইমার রাখা হয়েছিল : ট্রাইব্যুনালের মামলায় পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর বলে জানিয়েছে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল থেকে পরোয়ানা জারির তথ্য আগেই আসামির কাছে চলে যায়। এতে আসামি পালিয়ে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনা ঘটেছে বলেও জানান তারা। তাদের অভিযোগ, প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবস্থান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অসহযোগিতা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি গ্রহণের প্রক্রিয়াকে সময়সাপেক্ষ করে তোলে।
এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ২৫ জানুয়ারি প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা উত্তরাতে অবস্থিত গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনে যায়। কয়েকদিন আমরা সেখানে পরিদর্শন করি। গুম হওয়ার পর একজন ৮ বছর সেখানে বন্দি ছিলেন। তার স্মৃতি থেকে জবানবন্দি অনুযায়ী কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে দুই তলায় তিনটি টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়। এই রুমগুলোতে টর্চারের অনেক উপাদান ছিল। আবর্জনায় ভরা ছিল।
তিনি বলেন, সেখানে একটি নীল রংয়ের বালতিতে লাল টেপওয়ালা পাঁচটি বোমা ও তার লাগানো একটি টাইমার পাওয়া যায়। বিভিন্ন বাহিনীর যারা সেখানে দায়িত্বে ছিলেন তাদের জিঞ্জাসা করলাম, এখানে বোমা এলো কিভাবে? তারা বলেন, আমরা জানি না। ২৭ জানুয়ারি বোমা ডিসপোজাল টিম এসে সেটি নিষ্ক্রিয় করে। পরে আমরা এ বিষয়ে থানায় জিডি করি। আলামত ফরেনসিক করা হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, পরিদর্শনে আমরা উপস্থিত ডিসপোজাল টিমকে প্রশ্ন করি, এসব বোমার পাওয়ার কেমন? তারা বলেন, এগুলো যদি একসঙ্গে বিস্ফোরিত হতো তাহলে পুরো বিল্ডিংটাই উড়ে যেত। ওই বিল্ডিংয়ের একটি অংশে অস্ত্রাগার ছিল। এর কয়েকদিন পরেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আয়নাঘর পরিদর্শনের কথা। পুরো এলাকা সুইপ (নিরাপদ) করার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আয়নাঘর পরিদর্শনে যান। তিনি বলেন, সেখানে ২৭টি সেলের সন্ধান আমরা পাই। এখনো একটি অংশ দেখার বাকি । যেখানে অনেক কিছু আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্টের অপচেষ্টা : বিগত সরকার পতনের পর সেই সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। তারা বলেছে, থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক স্থাপনার আকার-আকৃতি, দেওয়াল ইত্যাদি ভেঙে ও বিকৃত করে প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা এগুলো ট্রেস (সন্ধান) করে পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছেন। বিভিন্ন ডিজিটাল এভিডেন্স (তথ্যপ্রমাণ), যেমন ভিডিও, অডিও, ইন্টারনেট ডেটা ইত্যাদি ডিলিট (মুছে দেওয়া) বা ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুছে দেওয়া সব তথ্যপ্রমাণ রিকভারি (উদ্ধার) ও রিস্টোরের (স্থাপন) কাজ করছেন বলেও জানায় চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়।