
প্রিন্ট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৩ পিএম

আবু বাসার আখন্দ, মাগুরা
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
নিদারুণ অযত্ন আর অবহেলায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতিমান পুরুষ, ছান্দসিক কবি কাজী কাদের নওয়াজের শেষ চিহ্ন মাগুরার বাড়িটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় এ কবির জীবনালেখ্য, সাহিত্যগুণ, মানবিক দিগ্দর্শন এবং রাজনৈতিক চেতনা ও দেশাত্মবোধ সম্পর্কে ধারণা লাভের সুযোগ পাবে।
মাগুরা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে উপজেলা সদর শ্রীপুর। সেখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে কুমার নদের তীর ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলা ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা পথ পেরোলেই মুজদিয়া গ্রাম। গ্রামের পিচঢালা সড়কের ধারেই পারিবারিক কবরস্থানে ঘুমিয়ে আছেন ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’, ‘মা’, ‘হারানো টুপি’র মতো কালোত্তীর্ণ জনপ্রিয় কবিতার স্রষ্টা কাজী কাদের নওয়াজ। আর সেখান থেকে একশ মিটার দূরে কাজলী বাজার যেতে রাস্তার বাম পাশে গৌরবের সাক্ষী হয়ে এখনো ঝিলিক দিচ্ছে পলেস্তারা খসে পড়া কবির ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি।
প্রায় ৯৯ শতক জমি ঘিরে গড়ে তোলা দ্বিতল বাড়িটির সবখানেই স্যাঁতসেঁতে ভাব। ইট-কাঠ আর চুন-সুরকির সহযোগে গড়ে ওঠা বাড়িটির ছাদের প্রতিটি কোনায়ই অসংখ্য ফাটল। কোথাও কোথাও খসে পড়েছে টালি। হারিয়ে গেছে প্রতিটি দরজা-জানালার চৌকাঠ। কেবল কঙ্কালসার বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে আজও কালের সাক্ষী হয়ে।
১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি কবির মৃত্যুর পরও পরিবারের সদস্যরা ২০০২ সাল পর্যন্ত বাড়িটিতে বসবাস করলেও অধিকাংশই এখন জেলার বাইরে ঢাকা-খুলনাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। স্থানীয় একটি গোষ্ঠী বাড়িটির বিশাল সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আর পৈতৃক নিবাস ছিল অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট গ্রামে। পিতা কাজী আল্লাহ নওয়াজ এবং মাতা ছিলেন ফাতেমুন্নেছা। ১৯১৮ সালে কবি বর্ধমান জেলার মাথরুন ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯২৯ সালে বহরমপুর থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৩৩ সালে স্কুল সাব-ইনস্পেকটর হিসাবে তার কর্মজীবনের সূচনা। দীর্ঘদিন তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সাতচল্লিশে দেশবিভাগের পর চলে আসেন বাংলাদেশে। এ সময় দক্ষিণা রঞ্জন জোয়ারদার নামে একটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে বিনিময় সূত্রে প্রায় ৬শ একর জমি এবং বাড়িটির মালিকানা পায় কবির পরিবার।
এই দেশে আসার পর কবি প্রথমে ঢাকার নবাবপুরের নবকুমার ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন দিনাজপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। ১৯৬৬ সালে ওই বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে ফিরে আসেন মাগুরায়। শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামের এই বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি শ্রীপুর মহেশচন্দ্র পাইলট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
কবি কাজী কাদের নওয়াজের সাহিত্য রচনা সম্পর্কে জানা যায়, ১৯২১ সালে শিক্ষক দ্বিজবাবুর উৎসাহে ‘বিকাশ’ পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ‘স্বদেশ প্রীতি’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯২৩ সালে মাসিক ‘শিশু সাথী’তে ‘ঘুমপাড়ানীয়া গান’ নামে একটি কবিতা প্রকাশের পর সাহিত্য সমাজে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মা’ কবিতায় কবির মাতৃভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
কবিতার প্রথম চারটি লাইন হলো-মা কথাটি ছোট্ট অতি/কিন্তু জেনো ভাই/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর/তিন ভুবনে নাই।
১৯৩৪ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মরাল’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর থেকে ‘নীল কুমুদী’ নামে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে ‘উতলা সন্ধ্যা’ ১৯৪৭ সালে এবং ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। জীবিত অবস্থায় কবি দেখেছেন তার লেখা কবিতা দেশে স্কুল পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে পাঠসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার ‘হারানো টুপি’ কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মজার বিষয়, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে উদ্ধৃত নিজের লেখা কবিতার সারমর্ম লিখেই তাকে পাশ করতে হয়েছে। কবিতাটির অংশবিশেষ : টুপি আমার হারিয়ে গেছে/হারিয়ে গেছে ভাইরে/বিহনে তার এই জীবনে/কতই ব্যথা পাইরে।
মাগুরার খ্যাতিমান কবি ও কলাম লেখক সাগর জামান বলেন, আমাদের অঙ্গনে তার মতো এমন একজন গুণী কবির পদচিহ্ন পড়েছে, যেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। অথচ কাদের নওয়াজ এখন একটি বিস্মৃত নামে পরিণত হয়েছে।
কবি সম্পর্কে ছড়াকার ও সাংবাদিক আবু সালেহ বলেন, সাহিত্যের সব শাখায় কবির প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২৩ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মোছলেম ভারত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তার ‘হারানো টুপি’ প্রকাশের পর সারা ভারতের সাহিত্যপাড়ায় তার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতাটির জন্য কাজী কাদের নওয়াজের প্রশংসা করেন। বাংলা সাহিত্যের এমন গুণী মানুষের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ ছিলেন নিঃসন্তান। কবির ভাই কাজী মালেক নওয়াজের ছেলে জাগরণি চক্র ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম) কাজী মাজেদ নওয়াজ বলেন, প্রকৃত অর্থেই যদি বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয় বা সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে অবশ্যই সহযোগিতা করব।