
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫২ এএম

এমএ মান্নান, লাকসাম-মনোহরগঞ্জ (কুমিল্লা)
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67f5856c7d678.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
বাংলায় জমিদারি প্রথা বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থাপত্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে কুমিল্লার লাকসামে নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদারবাড়ি অন্যতম। ব্রিটিশ আমলের কারুকার্যে নির্মিত এই জমিদারবাড়ি। এটি নবাববাড়ি নামেও পরিচিত। কুমিল্লা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে অবস্থিত সাদা রঙের বিশাল প্রাসাদটি। তৎকালীন ভারতবর্ষের একমাত্র নারী নবাব ‘ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী’ ১৮৭১ সালে এই জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। ছোটখাটো কিন্তু বেশ দৃষ্টিনন্দন নকশার দক্ষিণমুখী বাড়িটি বর্তমানে জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মহিলা নবাব ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন ভারত ও এশিয়ার প্রথম নারী নবাব। শিক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজে তার ছিল অসামান্য অবদান। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসাবে ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর লাকসামের নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদারবাড়িটি জাদুঘর হিসাবে উদ্বোধন করা হয়। এ স্থাপনা দেখতে প্রতিদিন দেশবিদেশের পর্যটকদের উপস্থিতি দেখা যায়। আশপাশে বেড়ানোর জন্য দর্শনীয় অনেক স্থান রয়েছে।
নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদারবাড়ির জাদুঘরে চারটি রুমের ১৫টি সেলফে ফয়জুন্নেছার ব্যবহৃত খাট, আয়না, ডাইনিং টেবিল, আলনা, দেওয়ালঘড়ি, সিরামিকের থালাবাসন, চায়ের কাপ, পিরিচ, কেতলি, পানের বাটা, আরামকেদারাসহ ৭৪টি আসবাবপত্র স্থান পেয়েছে। পর্যায়ক্রমে এর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাদুঘর সূত্র জানায়, প্রতিটি টিকিটের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন খোলা থাকে। শুক্রবার বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা এবং বাকি ৫ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন ৩-৪ শতাধিক দর্শনার্থী জাদুঘরে আসেন। শুক্রবার দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁওয়ে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জমিদার আহমেদ আলী চৌধুরী ও মা আরাফান্নেসা চৌধুরানী। জমিদার বংশের প্রথম কন্যাসন্তান ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। মুঘল রাজত্বের উত্তরসূরি এই মহীয়সী নারীর ছিল দুই ভাই, দুই বোন। ১৮৬০ সালে আরেক জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সঙ্গে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তাদের দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। একপর্যায়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পর তিনি সমাজ সংস্কার ও গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তার বিয়ের দেনমোহরের ১ লাখ ১ টাকা দিয়ে লাকসাম পশ্চিমগাঁয় সাড়ে তিন একর জমিতে এই বাড়ি নির্মাণ করেন। এ নান্দনিক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের দোতলা প্রাসাদে রয়েছে একটি সুন্দর প্রবেশদ্বার, একতলা বৈঠকখানা, টালির ঘাটসহ পুকুর, মসজিদ, কবরস্থান ও ঈদগাহ। বাড়িটি নির্মাণ করতে প্রায় তিন বছর লেগেছিল। ব্রিটিশ আমলের সিমেন্ট, রড, চুন ও সুরকি দিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁয়ের জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন। ১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সীর জীবনাবসান ঘটে।
ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেছা জানানা হাসপাতাল’। ১৮৯৩ সালে নওয়াববাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা এবং সড়ক নির্মাণ করে তার মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াববাড়ির সদর দরজায় একটি ১০ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ পালনের সময় তিনি মক্কায় হাজিদের জন্য একটি মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি জনহিতকর কাজেও প্রচুর অর্থ দান করতেন। ২০০৪ সালে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাউছার হামিদ যুগান্তরকে বলেন, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী সর্বজনীন ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তিনি নবাববাড়ির অবকাঠামো নির্মাণ, মানবিক, শিক্ষামূলক, জনকল্যাণমুখী ও ধর্মীয় কাজে অর্থ ব্যয় করেছেন। নারীশিক্ষার অগ্রদূত মহীয়সী এই নবাবের অবদানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তার স্মৃতি সংরক্ষণ ও নবাব ফয়জুন্নেছা জাদুঘরের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে প্রশাসন সবসময় সহযোগিতা করবে।
জাদুঘরের সমন্বয়ক সাংবাদিক এমএস দোহা যুগান্তরকে বলেন, সরকারের গেজেটভুক্ত প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসাবে নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি এখন দর্শনীয় স্থান। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এর উন্নয়নকাজ চলমান, যা ঐতিহাসিকভাবে এ বাড়িটিকে আরও মনোমুগ্ধকর, আকর্ষণীয় ও পর্যটনধর্মী করে তুলছে। আরও দুই শতাধিক নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে নতুন দুটি গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য। রংমহলকে রেস্টহাউজ হিসাবে সাজানো হয়েছে ভিআইপি অতিথি, নবাব পরিবারের সদস্য ও পর্যটকদের জন্য; যা উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।