
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৩ এএম
সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা
বেনাপোল কাস্টমসে দুর্নীতি ঘুস বাণিজ্যের মহোৎসব
নতুন কমিশনার আসার পর বেড়েছে বহুগুণ * নেওয়া হচ্ছে শুল্কের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67f58889ac4d3.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুসবাণিজ্যে যশোরের বেনাপোল কাস্টমসের স্বাভাবিক কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। আর এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঘোষণাবহির্ভূত ও নো-এন্ট্রি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অভিযোগ-গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান যোগদানের পর থেকে ঘুসবাণিজ্য ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন-সবাই ঘুসবাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমসে কোনো ডকুমেন্ট আসার আগেই কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করেন। মূল ভ্যালুর কত শতাংশ দিতে পারবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে দেন-দরবার হয়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় আমদানি শুল্কের ৫০ শতাংশ নগদ টাকা নিয়ে কিছু কাস্টমস কর্মকর্তা শুল্ক ফাঁকির মহোৎসবে জড়িয়ে পড়েন। আর কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে কম ভ্যালুর পণ্যের উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হন। তাই বাধ্য হয়েই তারা কাস্টমস কর্মকর্তাদের শর্তে রাজি হন। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারায়।
সূত্র জানায়, ২৪ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দরে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চালান আসে। এ পণ্যের আমদানিকারক হলো শাফা ইমপেক্স যশোর এবং রপ্তানিকারক ভারতের আরএস এন্টারপ্রাইজ। চালানে ৪৮টি আইটেম ছিল। এতে পণ্যের প্যাকেজ সংখ্যা ছিল ১২৬২টি। এর মধ্যে পরীক্ষাযোগ্য আইটেম ছিল পাঁচটি। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কোনো পরীক্ষা (টেস্ট) ছাড়াই মাত্র একদিনের ব্যবধানে সেই পণ্য খালাস নেন আমদানিকারক। এর মধ্যে সার্জিক্যাল, মেডিকেল ইকুপমেন্ট (আইসিইউ), অর্থোপেডিক আইটেম, টেস্ট কীট, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট কেমিক্যালসহ পাঁচটি পণ্য দ্রুত খালাসযোগ্য নয়।
২২ জানুয়ারি বেনাপোল কাস্টম হাউজ থেকে চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটের এমআর ইন্টারন্যাশনালের দুটি ট্রাক আটক করে বিজিবি। ট্রাকের পণ্য চালান ইনভেন্টরি করতে বেনাপোল কাস্টম হাউজ থেকে বিজিবি, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও শুল্ক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথ কমিটি গঠন করা হয়। এ চালানে অতিরিক্ত প্রায় ছয় হাজার ৫২৯ কেজি পণ্য পাওয়ার তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে নাট-বল্টু ছয় হাজার ৮০ কেজি, স্টার্টার মাইক্রো রিলে এক হাজার ৫০০ পিস, ট্রাম্পেট জাম্বো ও প্লাস্টিক হর্ন পাইপ ২৪০ কেজি, লং হোস মিউজিক্যাল জাম্বো ১১০ কেজি, বেল্ট পোলি টিলন পাইপ ১৮ দশমিক ৮৯ কেজি এবং গিয়ার সিম সেট সিঙ্গেল মিনার ট্রেলার ২৮ কেজি ছিল। এছাড়া বিপুল পরিমাণ মেডিসিন ছিল যা সরানো হয়েছে বলেও জানা গেছে।
১৭ ডিসেম্বর বন্দরের ৪২ নম্বর শেড থেকে মিথ্যা ঘোষণায় প্রায় দুই কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা ফেব্রিক্সের একটি চালান জব্দ করে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ চালানে বন্ডের (গার্মেন্টসের পণ্য, যেগুলোর শুল্ক পরিশোধ করা লাগে না) নামে ঘোষণা দেওয়া হলেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রিক্স (শার্টিং-স্যুটিংয়ের কাপড়, এর শুল্ক অনেক) আমদানি করে। গাজীপুরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান শিশির নিটিং ৬৮১ প্যাকেজ (ওজন ২৮ হাজার ৩০০ কেজি বা ২৮ টন) ফেব্রিক্স আমদানি করে। এর শুল্ক আসে প্রায় দুই কোটি টাকা। বেনাপোল স্থলবন্দরের ৪২ নম্বর শেডে ফেব্রিক্স প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গোপন সংবাদে জানতে পারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরপর চালান জব্দ করা হয়। তবে বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামানকে শুল্ক ফাঁকির ৪০ শতাংশ টাকা দিতে রাজি হন আমদানিকারক। এদিকে খালাসের আগে টাকা না পেয়ে পণ্য চালানটি আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতা জানান, সরকারের রাজস্ব আদায়ে তারা সহযোগিতা করেন। কিন্তু বর্তমানে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুসের টাকা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের চাহিদা মতো টাকা না দিলে তারা এইচএস কোড ভুলসহ নানাবিধ কথা বলে হয়রানি করেন। তিনি আরও বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের চাহিদা মতো টাকা দিলে যেকোনো অনিয়ম এখানে নিয়মে পরিণত হয়। আর চাহিদা মতো টাকা না দেওয়া হলে পণ্য আটক দেখানো হয়।
অভিযোগ-আমদানি পণ্যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া টাকার ৪০ শতাংশ কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য বন্দর থেকে খালাস নেন। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা জানান, কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বেনাপোল কাস্টমসে যোগদানের পর থেকে অন্য কর্মকর্তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। স্টাফরা কোনো ফাইল নিয়ে গেলে নিচের কর্মকর্তারা এইচএস কোড ভুল আছে, মূল্য বাড়িয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘুস নেন। ফ্রেশ ফাইলে গ্রুপ থেকে উপরের কর্মকর্তারা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নেন। আর নানা সুবিধা নেওয়া ফাইলে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। এসব কারণে আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য বন্দরমুখী হচ্ছেন। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, এসব অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। কোনো অভিযোগ থাকলে সেগুলো আমাকে দেন। আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।