
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১১ পিএম

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
দিন যত যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো তত সমৃদ্ধ হচ্ছে। এ খাতে বেড়ে চলছে সরকারি বরাদ্দ ও বেসরকারি বিনিয়োগ। জটিল রোগের চিকিৎসাও কমবেশি শুরু হয়েছে। এরপরও বিদেশমুখী রোগীর স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের মাধ্যমে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্য পূরণে স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের চিকিৎসাসেবা রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। নানা অন্তরায় ও সংকটে প্রতিবছর অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশমুখী হচ্ছেন। মূলত আস্থাহীনতার কারণেই এ খাতের নীতিনির্ধারকরাও চিকিৎসার জন্য বাইরে যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে হৃদরোগ, স্নায়বিক রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি জটিলতা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, উচ্চরক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস এবং মানসিক অসুস্থতার মতো সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। আক্রান্তরা ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করছে। এসব রোগের চিকিৎসায় শতাধিক মেডিকেল কলেজ, একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ২০টি বিশেষায়িত হাসপাতালসহ নামিদামি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়া ও সেবা অব্যবস্থাপনার রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও আচরণের ঘাটতিসহ অন্তত ২১ কারণে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি অনেকে আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে ব্যয় মেটাতে সক্ষম রোগীদের বিরাট একটি অংশ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও চীনসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছেন। এ সুযোগে বাংলাদেশি রোগীদের টার্গেট করে বিদেশের মেডিকেল ট্যুরিজমগুলোও চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা বাণিজ্য।
সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার চিত্র যাচাইয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের উদ্যোগে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি জরিপ করেছে। জরিপের তথ্য বলছে, মানুষ সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। গত বছর ৩৯ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতাল থেকে কোনো সেবাই নেননি।
দেশে চিকিৎসাসেবায় আস্থাহীনতার পেছনে ভুক্তভোগীরা যুগান্তরকে আরও কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এগুলো হলো-সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যা পাওয়া থেকে শুরু করে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তিতে দীর্ঘ সিরিয়ালে পড়তে হয়। সারা দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে আইসিইউ আছে ১ হাজার ১৯৫টি। এর ৭৫ শতাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। ৩৪ জেলা শহরে নেই আইসিইউ’র ব্যবস্থা। আইসিইউ স্থাপন নিয়ে খামখেয়ালিতে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সরেজমিন একাধিক হাসপাতাল ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি অকেজো থাকায় সময়মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। রোগীদের প্রতি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা অবহেলা করেন। রোগ নির্ণয়ে উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিচালনায় দক্ষ টেকনিশয়ান সংকট ও ওষুধের স্বল্পতা আছে। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার মোট ব্যয়ের ৮৯ ভাগ টাকা ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হয়। এরপরও কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না। ফলে বছরে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে যান। চিকিৎসাসেবায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মতো বাইরে চলে যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, জীবনরক্ষাকারী মাত্র ১১৭টি ওষুধের দামে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বাকিগুলো প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ঠিক করে। কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে দফায় দফায় দাম বাড়ানো নিয়মে পরিণত করেছে। সংকটে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। এছাড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে দক্ষ চিকিৎসক তৈরিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংকট আছে। চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় একাধিক মেডিকেল কলেজ করেছে। শিক্ষার মান না বাড়িয়ে ১৬ বছরে ২২টি সরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোতে অবকাঠামোগত ঘাটতি চরমে। ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের অনেকগুলোতে নিজস্ব হাসপাতাল নেই। চাহিদার ৫৭ শতাংশ শিক্ষক দিয়ে চলছে সরকারি মেডিকেল চিকিৎসা শিক্ষা।
ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর সদ্যসাবেক মহাসচিব ডা. মো. আব্দুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আগের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। নিজেদের চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের কাজের সুযোগ দেয়নি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও রেফারেল সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। চিকিৎসক প্রতিনিধি থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারকরা আস্থার সংকটে চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটে গেছেন। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে চিকিৎসা ব্যয় বহনে সক্ষম রোগীদের বিরাট অংশ প্রতিবছর বাইরে যাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ আছে যেখানে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাতে পারলেই কষ্ট লাঘবের সব কাজ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মেডিকেল টেকনোলজিতে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে গত ২০ বছরে চিকিৎসা টেকনোলজি ও গবেষণায় কোনো অগ্রগতি নেই। বিনিয়োগ নেই। গত এক বছরে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্স কাউন্সিলের (বিএমআরসি) গবেষণা বাজেট ছিল মাত্র ১৬ কোটি টাকা। অথচ একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেই বরাদ্দের ৭০ ভাগ ব্যয় হয়।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার মতো টেকনোলজি না থাকার পর ভারত ও থাইল্যান্ড মডেল রোগীদের আস্থা ও প্রশান্তিদানে সক্ষম হয়েছে। রোগীরা সেখানে ঝুঁকছে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগীদের বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি, শান্তি প্রদান জরুরি। টেকনোলজি অগ্রসর ও কোলাবরেশনের মাধ্যমে কম খরচে সেবা দিতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন দরকার। না হলে রোগী ধরে রাখা যাবে না।
এদিকে এমন প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের মতো আজ দেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২৫।’ এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সুস্থ সূচনা, আশাবাদী ভবিষ্যৎ।’ এই প্রচারণায় সব দেশের সরকারকে প্রতিরোধযোগ্য মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যু বন্ধে প্রচেষ্টা জোরদার এবং নারীদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।