
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৭ এএম
ইদ্রাকপুর কেল্লা: মুঘল স্থাপত্যকর্মটির এখন বিবর্ণদশা

আরিফ উল ইসলাম, মুন্সীগঞ্জ
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67ef143beb79e.jpg)
আরও পড়ুন
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ১৯৬০ সালে বাংলার সুবেদার ও সেনাপতি মীর জুমলা ইছামতী ও ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় একটি দুর্গ নির্মাণ করেন; নাম ইদ্রাকপুর কেল্লা। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকাকে মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজদের হামলা থেকে রক্ষা করতে এলাকাটিকে সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে কেল্লাটি নির্মাণ করেন তিনি।
জনশ্রুতি আছে, দুর্গটির নাম ইদ্রাকপুর কেল্লা রাখা হয়েছিল। কারণ, সেসময় এলাকাটির নাম ছিল ইদ্রাকপুর। এখন এলাকাটির নাম আর ইদ্রাকপুর নেই। তবে এর এক কিলোমিটার দূরে ইদ্রাকপুর নামে একটি গ্রাম রয়েছে। বর্তমান জেলা শহর মুন্সীগঞ্জে এই কেল্লাকে ঘিরেই যে বসতি গড়ে উঠেছে, তা ইতিহাসে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যখন কেল্লাটি নির্মাণ হয়, তখন এখানে কোনো বসতি ছিল না।
ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ক্রমাগত জলদস্যুদের আক্রমণ আতঙ্কিত করে তুলেছিল ঢাকার সুবেদারদের। আরাকান, পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা সমুদ্র অঞ্চল থেকে ছিপ নৌকা নিয়ে মেঘনার বুক চিরে এগিয়ে আসত ধলেশ্বরীর দিকে। ধলেশ্বরী মোহনায় এসে ঢুকে পড়ত শীতলক্ষ্যায়। সুলতানি আমলে জলদস্যুরা লুটতরাজ করত সোনারগাঁয়ে। ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পর সোনারগাঁয়ের প্রতি আকর্ষণ কমে যায় তাদের। ঢাকার দিকে দৃষ্টি ফেরায় তারা।
নদীবেষ্টিত হওয়ায় জলদস্যুরা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো নির্ধারণ করে নেয় খুব সহজে। শীতলক্ষ্যা দিয়ে উত্তরে অগ্রসর হয়ে বালু নদীর শাখা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় প্রবেশ করে ঢাকায় আক্রমণ ও লুটতরাজ শুরু করে তারা। এ আক্রমণ ও লুটতরাজ ঠেকাতে সুবেদার মীর জুমলা একটি পরিকল্পনা নিয়ে প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকাকে দলদস্যুদের আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে তিন ধাপে প্রতিরক্ষাদুর্গ তৈরি করা হবে। নদীর তীরে গড়ে তোলা এ দুর্গ জলদুর্গ নামে পরিচিত হবে। আরও সিদ্ধান্ত হয়, প্রথম দুর্গটি নির্মিত হবে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে ইছামতী নদীর তীরে ইদ্রাকপুর অঞ্চলে। সেসময় ধলেশ্বরীর জল ছুঁয়ে ইছামতী বয়ে যেত ইদ্রাকপুরের পাশ দিয়ে। দুর্গের পূর্ব দেওয়ালের পাশে উঁচু স্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। এরপর ধলেশ্বরীর দিকে মুখ করে বসানো হবে কামান। চেষ্টা করা হবে শীতলক্ষ্যায় প্রবেশের আগেই জলদস্যুদের নৌকা যেন কামানের গোলায় ভীত হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এক স্তর নিরাপত্তায় ঠেকানো যাচ্ছিল না জলদস্যুদের আক্রমণ। তাই দ্বিতীয় নিরাপত্তা দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় মোহনা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে সোনাকান্দায়। এখানে কামান বসানোর স্তম্ভ নির্মাণ করা হয় পশ্চিম দিকের দেওয়ালে। জলদস্যুদের নৌকা শীতলক্ষ্যার সীমানায় প্রবেশ করলেই আঘাত হানা হতো। চূড়ান্ত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তৃতীয় নিরাপত্তা দুর্গ তৈরি করা হয় আরও ছয় কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জে। এভাবেই তিনটি দুর্গ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন সুবেদার মীর জুমলা।
১৬৬০ সালে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর চমৎকার নিদর্শন ইদ্রাকপুর কেল্লার আয়তন ৮২ মিটার বাই ৭২ মিটার। প্রায় ২ একর জমিতে ইট-সুরকির এ দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। পুরো দুর্গটি খিলান আকৃতির খাঁজকাটাসদৃশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা। চার কোণে রয়েছে চারটি গোলাকার মঞ্চ চৌকি। প্রধান মঞ্চটি অন্যগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ আকার ও উচ্চতাবিশিষ্ট। এটি পূর্বদিকে প্রাচীরসংলগ্ন। যদিও সে সময় চারদিকে নজরদারির জন্যই এ সুউচ্চ প্রধান মঞ্চটি নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন নগরায়ণের ফলে এর ছাদে উঠলে দৃষ্টি তেমন বেশিদূর এগোয় না। দক্ষিণদিকে দক্ষিণ কোটগাঁও গ্রাম। দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারে ঘেঁষা টেনিস মাঠ ও শ্রীনাথ ক্লাব। পূর্বে পুকুর, লেডিস ক্লাব ও ডাকবাংলো। পশ্চিমে লাগঘেঁষা এভিজেএম (অ্যালভার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন) সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। উত্তরে পুকুর ও মুন্সেফ কোয়ার্টার। বহুতল ভবনের মাঝে এটিকে এখন নিহায়ত গেরুয়া রঙের ছোট একটি জরাজীর্ণ ইমারত বলেই মনে হয়। মূল মঞ্চের পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে তলদেশে। সিঁড়ির মুখ বহুকাল আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভেতরে প্রবেশ করা হতো এবং এর মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুত করে রাখা হতো।
অন্যদিকে ছাদে ওঠার প্রশস্ত সিঁড়ির উত্তর কোনায় মুখবন্ধ একটি গম্বুজ আকারের ইটের ভগ্নস্তূপ রয়েছে। এটি ছিল সুড়ঙ্গপথ। পরে এর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। লোকমুখে প্রচলিত আছে, ইদ্রাকপুর দুর্গের সিংহদ্বার দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেই দেখা যাবে একটি সুড়ঙ্গপথ। ইতিহাসে কথিত আছে, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ দিয়ে এ সুড়ঙ্গপথটি মিলিত হয়েছে ঢাকার লালবাগ এবং নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা কেল্লার সুড়ঙ্গপথের সঙ্গে; যাতে সৈন্যরা দুর্যোগ মুহূর্তে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে। বর্তমানে সুড়ঙ্গটির মুখ বন্ধ রয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে এখনো দাঁড়িয়ে আছে মুঘলদের সেই প্রাচীন স্থাপনা ইদ্রাকপুর দুর্গ। এর নির্মাণশৈলী অতি মনোমুগ্ধকর। ১৯৯৫ সালের দিকে কিছু সংস্কার করা হলেও এরপর আর কোনো সংস্কার হয়নি। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করলে মূল্যবান এ পুরাকীর্তির যেমন স্থায়িত্ব বাড়বে; তেমনই নয়নাভিরাম এ মুঘল স্থাপত্যকর্মটি হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান।