
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১১ পিএম

রেজাউল করিম প্লাবন
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
অবহেলিত চরাঞ্চলের মানুষের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাব ওঠেছে উপদেষ্টা পরিষদে। সেখানে মন্ত্রণালয়টির পক্ষে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা জোরালো আলোচনা করেছেন। পরে প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে অর্থ উপদেষ্টাকে নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উপদেষ্টা বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন।
১৩ মার্চ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি উস্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। পরে এতে অন্যান্য উপদেষ্টা আলোচনায় অংশ নেন। এদিনের বৈঠকে সরাসরি চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়ে আলোচনা হলেও দুটি বিকল্প রাখা হয়েছে। একটি স্থানীয় সরকারের অধীনে চরবিষয়ক অধিদপ্তর, অপরটি একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে পূর্ণাঙ্গ চরবিষয়ক বিভাগ। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ওঠে আসবে আসলে কোনটি প্রয়োজন। এরপর সেটিই বাস্তবায়ন করবে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৩৯টি। এর বাইরে বেশ কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হলে মোট মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৪০টিতে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের ৩২টি জেলার ১০০টি উপজেলা চর বেষ্টিত। এসব চরে এক কোটির ওপর মানুষ বসবাস করে। নদীর দুই ধারে বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। চরাঞ্চলের মানুষের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামে মাত্র ১৯ লাখ মানুষের অধিকার নিশ্চিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন হয়েছে। অথচ দেশের সব অধিকার বঞ্চিত এক কোটির উপরে বসবাসকারী চরের মানুষের জন্য পৃথক কোনো মন্ত্রণালয় নেই। তারা আরও বলেন, যেসব বৈষ্যমের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার চরের মানুষ। এতদিন রাজনৈতিক সরকারগুলো তাদের রাজনীতির মারপ্যাঁচে আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি-দ্রুততম সময়ে চরাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম যুগান্তরকে বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বিগত সরকারগুলো কেন কাজ করেনি তা বোধগম্য নয়। একই দেশের মানুষ অথচ তাদের কোনো মৌলিক অধিকার নেই। দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে কীভাবে দেশের উন্নয়ন সম্ভব? আমি নিজে কুড়িগ্রামের চরে গিয়ে দেখে এসেছি। আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। চরের মানুষের নিদারুণ বর্ণনা শুনেছি। এ বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। সবাই ইতিবাচক। আশা করি চরের মানুষের জন্য ভালো কিছু হবে।
সরকারি তথ্যমতে, বগুড়ায় চর উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। চর জীবিকায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার চরাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করলেও সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। সংগঠনটি বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। এর বাইরে বেশকিছু এনজিও সংস্থা কাজ করে চর নিয়ে। কিন্তু সেগুলোও দাতা নির্ভর।
চরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী চরের মানুষ। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় তা এখানে বিগত ৫৪ বছরেও পৌঁছায়নি। আমি মনে করি চরের মানুষদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বিষয়টি আলোচনাও হয়েছে। চরের মানুষের জন্য ভালো কিছু হবে এ আশা করছি।
এদিকে দীর্ঘদিন থেকে চরাঞ্চলের মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে চর উন্নয়ন কমিটি, কুড়িগ্রাম। তারা সারা দেশে চরাঞ্চলের মানুষকে একটি প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও চরগুলোতে মানুষদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। এ বিষয়ে কথা হয় চর উন্নয়ন কমিটি, কুড়িগ্রাম জেলার আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবুর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দেশ অনেক এগিয়ে গেছে কিন্তু চরাঞ্চলের এক কোটি মানুষ এখনও মান্ধাতা আমলেই পড়ে আছে। না আছে তাদের শিক্ষা, না আছে খাদ্যের নিশ্চয়তা। অনেক চরের মানুষ রাতে জানে না সকালে কি খাবে। এমন অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে চরের মানুষ। এজন্য আমরা চরের মানুষদের নিয়ে আন্দোলনে নেমেছি। তাদের ভাগ্যের বদল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আমাদের এই যৌক্তিক দাবি সরকারের মেনে নিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছে, জেলায় অতি দরিদ্রদের হার ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ নদী ভাঙন এবং চরে বসবাসকারী মানুষের অনিশ্চিত জীবনযাপন। এ পরিপ্রেক্ষিতে এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে চরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবি উঠেছে তৃণমূল থেকে।
এদিকে চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিতে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে চর কড়াই বরিশালে সমাবেশ হবে বৃহস্পতিবার। এতে কয়েক হাজার চরের মানুষ অংশগ্রহণ করবেন বলে আয়োজক চর উন্নয়ন কমিটি জানিয়েছে। চিলমারী নদীবন্দরেও একটি সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে।
তথ্যমতে, কুড়িগ্রামের ২৪ লাখ মানুষের মধ্যে ১৮ লাখই গরিব। এর মধ্যে হতদরিদ্র ১৪ লাখ। জেলাটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী। এগুলোর অববাহিকায় রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক চর। প্রায় সাড়ে ৮০০ বর্গ কিলামিটার চরে বসবাস করেন ৬ লাখ মানুষ। এসব চরে বসবাসকারী মানুষের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। ভৌগোলিকভাবে নদী ও চরবেষ্টিত জেলা হওয়ায় অন্যান্য জেলার চেয়ে এ জেলার সমস্যাগুলো অনেকটা ভিন্ন ধরনের। যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছেন চরের মানুষ । এসব চরাঞ্চলে মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিশুরা ৫ম শ্রেণি পাশের পর আর শিক্ষা নিতে পারে না। মেয়েরা পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক নিরাপত্তার কারণে বাধ্য হয়ে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। এই বাল্যবিয়ের হার ৭৮ ভাগ। এসব এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলগুলোতে মোট প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা ৯১ হাজার ৬৭২ জন। চর উন্নয়ন কমিটির নেতাদের দাবি, দ্রুত একটি মন্ত্রণালয় গঠন করে পিছিয়ে পড়া এসব মানুষকে মূল স্রোতে নিয়ে আসতে হবে। তাদের বিশ্বাস বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় এ মন্ত্রণালয় দ্রুত গঠন হবে।