
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০২ এএম

জুলাই অভ্যুত্থানে প্রিয়জন হারানো কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা। ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেলেও শহিদ পরিবারে কান্না থামছে না। এখনও স্বজন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দুচোখে অন্ধকার দেখছে অনেক পরিবার। তাই শহিদ পরিবারগুলোতে নেই ঈদের আনন্দ-শুধু আছে, প্রিয়জনের শূন্যতায় বিষাদের সুর। আয়ের উৎস না থাকায় অনেকে ঈদের বাজারও করতে পারেননি। আর ঈদের আগে এসব শহিদ পরিবারের খোঁজ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ শহিদ পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন-ঈদের আগে আমরা খেয়ে আছি, নাকি না খেয়ে আছি, তা দেখতে কেউ আসেনি।
৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় শাহরিয়ার খান আনাস। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সি আনাসের গুলি লাগে বুকের বাঁ-পাশে। রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে দাদির কবরে শুয়ে আছে এই কিশোর।
আনাসের মা সানজিদা খান বলেন, আনাস আমার প্রথম সন্তান। ও ঈদের (ঈদুল ফিতর) দিন জন্মেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ১৮ পার হয়েছে। তার মুখেই আমি প্রথম মা ডাক শুনি। আমরা শুধু মা-ছেলে ছিলাম না, দুজন ভালো বন্ধু ছিলাম। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। ছেলেটি প্রকৌশলী হতে চেয়েছিল। ছেলেটি চলে যাওয়ার পর দুই মাসের মতো বিছানা থেকেই উঠতে পারিনি। তিনি বলেন, যেদিন ছেলেটির গুলিবিদ্ধ লাশ মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে অটোরিকশায় তুলে কোলে করে বাসায় আনি-সেদিনই আমি মরে গিয়েছি। আনাসের ছোট আরও দুই ভাই আছে। ওদের সঙ্গে কথা বললে বারবার আনাসের স্মৃতি সামনে ভেসে আসে। ঠিকমতো খাবার পেটে যায় না। অস্থিরতা পেয়ে বসলে ওর কবরে ছুটে যাই।
আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, বাবা-মা সন্তানদের খুশি রাখতে সর্বোচ্চ ত্যাগ করেন। কিন্তু এবার আনাস না থাকায় আমাদের পরিবারে কোনো ঈদের আনন্দ নেই। তবু ছোট দুই সন্তানের জন্য ভালো থাকতে হচ্ছে।
১৯ জুলাই শহিদ হন আসলাম হোসেন। যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর নিজ বাসায় ঢুকে তাকে গুলি করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে পুলিশ। মা-বোনের চোখের সামনেই নিহত হন আসলাম। ছেলের মৃত্যুর পর মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তার ৮০ বছরের বৃদ্ধ মাসহ গোটা পরিবার।
আসলামের মা মমতাজ বেগম যুগান্তরকে বলেন, বাসার ভেতরে ঢুকে আমার সন্তানকে গুলি করে মারা হয়েছে। ছেলে ছিল আমার সবকিছু। এখন আর কেউ নেই। খেয়ে আছি, না কি না খেয়ে আছি-তা কেউ দেখতে আসে না। আয়ের উৎস না থাকায় ঈদের বাজার করতে পারিনি। আমার কষ্ট দেখার কেউ নেই। এরপর কান্নায় ভেঙে পড়েন মমতাজ।
স্থানীয়রা বলছেন, আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ১২ বছর আগেই আসলামকে ছেড়ে যায় তার স্ত্রী। এরপর মা মমতাজ বেগমকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় বোনের বাসায় বসবাস শুরু করেন তিনি। বোনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শুরু করেন ভাতের ব্যবসা। যাত্রাবাড়ী ও তার আশপাশ এলাকার বিভিন্ন দোকান কর্মচারীদের মাঝে বিক্রি করতেন ভাতের বাটি। ওই টাকায় চলত আসলাম ও তার বোনের সংসার। আসলাম না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা।
আসলামের বোন শারমিন যুগান্তরকে বলেন, আমার ভাইয়ের উপার্জনে পুরো পরিবার চলত। ভাই মারা যাওয়ার পর আমাদের ব্যবসা বন্ধ। এখন আমাদের উপার্জন নেই। যেখানে ভাত জুটছে না-সেখানে ঈদের প্রস্তুতি কিভাবে নেব।
এদিকে অনেক চেষ্টার পর সর্বশেষ মঙ্গলবার পরিবারটির হাতে ৫ লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন।
আন্দোলনে আসলামকে হত্যার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করে ভুক্তভোগী পরিবার। তবে সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা খোঁজ না রাখায় মামলা নিয়ে শঙ্কায় পরিবারটি। তাদের দাবি-মামলা করেছি। কিন্তু সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ আমাদের পাশে নেই। এখন মামলা নিয়ে আমরাই ভয়ে আছি।
জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহিদ হন জাহাঙ্গীর আলম। ঈদের আগে অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তার স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ নেওয়া হয়নি। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী তাসলিমা বেগম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মাত্র কিছু দিন আগে আমার স্বামী শহিদ হয়েছেন। এত অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের আর কেউ খোঁজ রাখছে না। কিভাবে ঈদ করব এবং ঈদের বাজার করব-সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহিদ হন জসিম উদ্দিন। তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া যুগান্তরকে বলেন, গত বছর স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করেছি। ঈদে যা কিছু দরকার হতো সবকিছুই তিনিই ব্যবস্থা করতেন। এবার স্বামী নেই। ঈদে কি করব বুঝতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের খোঁজ নেওয়া হয়নি।
শহিদ জুনায়েদের বাবা শেখ জামাল হাসান বলেন, রোজার মাসে জুনায়েদ আমাদের সঙ্গে অনেক আনন্দ করত। সবার সঙ্গে মার্কেটে গিয়ে নতুন জামা-কাপড় কিনত। কিন্তু এবার ঈদে আগের সেই অবস্থা নেই। ছেলেটাকে ছাড়া ইফতার মুখে দিতে পারি না। ওকে ছাড়া কীভাবে মার্কেটে যাব, বারবার সেই কথা মনে ধাক্কা দেয়।
শহিদ ইশমামুল হকের মা শাহেদা বেগম ফোনে বলেন, ২০১৭ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানরা কাজ করে সংসার চালাত। রোজায় ইফতার ও ঈদের জন্য কাপড়-চোপড় কিনে দিত। এখন খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। রোজায় জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ইফতারসামগ্রী কিনে দিয়েছিলেন। তবে ঈদের আগে কেউ কোনো আর্থিক সহযোগিতা করেননি।
শহিদ রাকিব হওলাদারের মা শিল্পী বেগম বলেন, একমাত্র ছেলের রোজগারে আমার সংসার চলত। এখন কোনো রকমে দিন যাচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে কেউ সহযোগিতা করেননি।
শুধু আসলাম হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ও জসিম উদ্দিন নন, ঈদের আগে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অধিকাংশ শহিদ পরিবারের খোঁজ নেননি অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ শহিদ পরিবারের সদস্যরা।