
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৪০ এএম

মোজাফফর আহমেদ
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
আমাদেরও একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। সব পারি বলা এই আমরা তখন অযোগ্য ছিলাম। কী চাকরি, কী ব্যবসা। ওরা তো আমাদের চাকরবাকর হিসেবেই ট্রিট করত। তাদের বৈষম্য আর রূঢ় আচরণের খাতাটা ছিল অনেক লম্বা। আমাদের সহ্যের মাত্রাটাও কম ছিল না। কিন্তু এই সহ্য ক্ষমতার সীমায় ছেদ পড়ল। ঘুরে দাঁড়ালাম। শুরু হলো পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালির যুদ্ধ। ঐক্যবদ্ধ মনোবল আর দৃঢ় মানসিকতায় পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
কথাগুলো যত সহজে বললাম, যুদ্ধটা তত সহজ ছিল না। সেই যুদ্ধে স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। লাখ লাখ শহিদের রক্তের ওপর ভর করে এসেছে এই স্বাধীনতা। ৯ মাসের যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাত বর্ণনা খুব কঠিন।
শুরু থেকেই আমরা পাঞ্জাবি, বিহারি, বেলুচিস্তানের লোকজনের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলাম। তারা আমাদের সহ্য করতে পারত না। সব সময় খারাপ আচরণ করত। তখনই মনে হচ্ছিল আমরা এক পরাধীনতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। আমি তার ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
যুদ্ধ শুরু হলো। ১০ এপ্রিল প্রশিক্ষণ নিতে চিলমারীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা রৌমারী যাই। তখনও পুরো প্রশিক্ষণ শুরু হয়নি। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের সেখান থেকে ভারতের দার্জিলিং পাঠানো হলো। রৌমারীর মাইনকার চর থেকে গাড়িযোগে আমরা সীমান্তবর্তী উপজেলা ফুলবাড়ী দিয়ে ধুবরি পৌঁছাই। সেখান থেকে কোচবিহারের রায়গঞ্জে গিয়ে আমরা তিনদিন অবস্থান করি। সেখান থেকে দার্জিলিং যাই। এখানে পাহাড়ের ওপর একটি সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট আছে। টিমে ছিলাম ২০০ সহযোদ্ধা। সেখানে প্রশিক্ষণ শুরু হলো। আমাদের এই ক্যাম্পের নাম ছিল মুজিব ক্যাম্প। আমাদের কমান্ডার ছিলেন মুজিবুর রহমান। উচ্চমাধ্যমিক পাশ না থাকায় আমরা উচ্চতর প্রশিক্ষণ পেলাম না। ১৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। লালমনিরহাট বুড়িমারি হাইস্কুলে ক্যাম্প করা হয়। এখানে ৬নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খাদেমুল বাশার। সেখান থেকে আমরা যাই কুড়িগ্রামের সাহেবগঞ্জে। এখান থেকে আমরা ভূরুঙ্গামারী অপারেশন যাই। ভূরুঙ্গামারী কলেজে পাকবাহিনী ক্যাম্প করে মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে নারীদের নির্যাতন করে। আমরা সেখানে হানা দিই। তারা পালিয়ে যায়। সেখানে বেশ কয়েকজন মা-বোনকে আমরা বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করি। অভিযান শেষে আমরা কুড়িগ্রাম সদরের টগরাইহাটের কাউয়াহাগা খেয়া পার হয়ে উলিপুরের বুড়াবুড়িতে এসে অশ্বিনী সরকারের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করি। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সব অভিযান এখান থেকেই সম্পন্ন করি। এখান থেকেই আমরা ১৫ জনের দল নিয়ে গাইবান্ধার বাহাদুরাবাদ ঘাটে অপারেশনে যাই। সেখানে আমরা ফেরি ডুবিয়ে দিই যাতে পাক হানাদাররা পারাপার হতে না পারে। এই অপারেশনে নৌবাহিনীর ৪ জন ছিলেন। দলনেতা আমাকেই পানিতে নামার নির্দেশ দেন। পাকবাহিনীর আমাদের লক্ষ্য করে মর্টার শেল নিক্ষেপ শুরু করল। একটি মর্টারের বিস্ফোরণে শাহজাহান নামের একজন সহযোদ্ধা শহিদ হন। আমাদের গুলিতেও অনেক পাক সেনা নিহত হয়।
লালমনিরহাট পাওয়ার হাউজ রেকিং করার জন্য ২০০ সদস্যের একটি টিম পাঠানো হয়। সেদিন আমি অন্য টিমে ছিলাম। সেই রেকিং অপারেশনে আমাদের ১১০ জন শহিদ হন।
১৪ ডিসেম্বর, আমরা কুড়িগ্রামে। আমাদের ওপর নির্দেশনা এলো ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিতে। আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সেখানে আমাদের ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হলো। এর দুদিন পর দেশ বিজয়ের ঘোষণা এলো। আমাদের যুদ্ধ সার্থক হলো।
দেশ স্বাধীনের উদ্দেশ্য ছিল অনেক। শুধু স্বাধীনতাই পেয়েছিলাম। অনেকেই অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাস্তবায়ন করেননি। তবে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। দুর্নীতিও যে হয়নি, তা বলব না। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যখন শুনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছে, তখন অনেক খারাপ লাগে। তবে প্রকৃত অনেক যোদ্ধা এখনো স্বীকৃতি পাননি। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সামনে এগিয়ে যাক, প্রত্যাশা করি।
লেখক : সাবেক কমান্ডার, চিলমারী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কুড়িগ্রাম