
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৩ এএম

আবু সালেহ মো. নুরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
যুদ্ধ মানে শুধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন নয়। যুদ্ধ মানে মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখার তীব্র আকাক্সক্ষা! মৃত্যুর ঘ্রাণ নিজের গায়ে মাখিয়ে নেওয়ার আনন্দ। আমি তেমনি একজন সম্মুখযোদ্ধা। এই যুদ্ধে গলা জড়িয়ে ও বুক জাপটে ধরা বন্ধুকে হারিয়েছি। এক সাথে নতুন দেশের স্বাধীনতা উপভোগ করব বলা সাথীকেও তখন হারিয়েছি। আর বেদনাভরা হৃদয় নিয়ে মৃত্যুপুরী থেকে ফেরা আমি এখনো বেঁচে আছি!
শুরুটা যুদ্ধের আগে থেকেই বলি। দেশের স্বার্থে আমার আন্দোলনে অংশগ্রহণ সেই ১৯৬২ থেকে। তখন শিক্ষা আন্দোলন হয়েছে। এরপর ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে আমার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ।
আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের মূল একটি উদ্দেশ্য ছিল। সেটি হলো-এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও বৈষম্য দূর করা। সেই সুযোগটি আগেও একাধিকবার এসেছে কিন্তু ৭১ ছিল মোক্ষম সময়। পাকিস্তান ইচ্ছা করেই যুদ্ধ বাধিয়ে দিল। আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করলাম। যুদ্ধ হবে এবং জিততে হবে।
মাঠে নেমে পড়লাম। যুদ্ধের শুরুতেই আমি শেরপুর পৌরসভার বাসা থেকে শহরের ভেতরে গেলাম। শেরপুর শহর মূলত হিন্দুপ্রধান এলাকা। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্ধুদ্ধ হলাম প্রথম কাজ হিসাবে এই হিন্দুপাড়া রক্ষার দায়িত্ব নিলাম। রামদা, হকিস্টিক নিয়ে শুরু হলো আমাদের প্রাথমিক যুদ্ধ। পরবর্তীতে আমরা যখন খবর পেলাম পাক হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল হয়ে শেরপুরের দিকে আসছে, তখন আমাদের কিছু আনসার, মুজাহিদ তাদের সাথে নিয়ে থানা থেকে অস্ত্র নিলাম। প্রথমে পাক বাহিনী কালিহাতি ব্রিজের কাছে আসে। আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সেখানে টিকতে না পেরে তারা মধুপুরে যায়। এখানে কোনো ব্রিজ ছিল না। এখানে পাক বাহিনী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ছিল আর আমাদের ছিল মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল। একাত্তরের ৯ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হওয়া নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হেলিকপ্টার থেকে হামলা করে। তারা উপর থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এতে অনেকেই মারা যান। ২৫ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ব্যাপক মর্টারশেলের বিস্ফোরণ ঘটায় এবং শেরপুর শহরে শনিবিগ্রহ মন্দিরের পুরোহিতকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় দালালদের সহায়তায় শহরের দোকানপাট লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, দখল ও নির্মমভাবে হত্যাসহ ধর্ষণ-অত্যাচার চালায়।
আমরা চিন্তায় পড়লাম। বেছে বেছে তারা হিন্দুদের আক্রমণ করা শুরু করল। বন্ধু মাসুদ, নালিতাবাড়ীর মুকুলসহ আমার দায়িত্ব পড়ল হিন্দু বাসিন্দাদের বর্ডার পার করে দেওয়া। আমরা বর্ডারে পোড়া খাসিয়া এলাকায় গেলাম। সেখানে ৩টা গাড়িতে করে লোকজন নিয়ে ভারতে গেলাম। ২৬ এপ্রিল ভোরে আমরা ভারতের হালচাটি গেলাম। সেখানে ইয়ুথ ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ময়মনসিংহের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, যিনি পরে ধর্মমন্ত্রী ছিলেন। সেখানে পাহাড়ঘেরা রমনাবাগে ২৯ দিন আমরা ট্রেনিং নেই। এরপর ভারতের পাচংপানিতে ক্যাম্প করি। আমরা প্রথম অপারেশনে যাই শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে। সেখানে আরফান মাস্টারের বাসায় পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। আমরা আমাদের ক্যাম্প থেকে তাদের ওপর গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেই। পরবর্তীতে তিনটা কোম্পানির যোদ্ধা কয়েকটি গাড়িতে করে সম্মুখযুদ্ধে নেমে পড়ি। আমাদের সাথে কাটআউট গ্রুপও যোগ দেয়। আমরা আজিজের নেতৃত্বে একটি কাটআউট গ্রুপ বান্দরঘাটা ক্যাম্পের পাশে রেখে দেই। বাকিরা র্যাকি করে এগোতে থাকি। আমাদের মধ্যকার একজন আবুল হোসেন তিনি দৌড় দেওয়া মাত্রই পাক হানাদাররা ব্রাশফায়ার করে। এতে তিনি সেখানেই মারা যান। যুদ্ধের সময় দেখেছি মৃত্যু কত কাছ দিয়ে যাচ্ছে। আমার পাশে থাকা আরও ২ জন শহিদ হলেন। সেদিন আমিও শহিদ হতে পারতাম। ১৯৭১ সালের সঙ্গে ২০২৪ এর মিল নেই। ৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। ২৪ এ যা হয়েছে সেটি একটি দেশের মধ্যকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সফলতা।
লেখক : সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার।