ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন: চট্টগ্রাম-৫
আলোচনায় বিএনপির মীর হেলাল, জামায়াতের সিরাজ

মো. আবু তালেব, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67db4360eeec3.png)
চট্টগ্রামের অন্যতম উপজেলা শান্তির জনপদ খ্যাত হাটহাজারী বিগত দেড় দশক ধরে নানা ঘটনায় আলোচিত। বন্দরনগরী লাগোয়া এই জনপদটি চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী-বায়েজিদ আংশিক) আসন হিসাবে পরিচিত। এটি দেশের আলোচিত কওমিপন্থি আলেম-ওলামাদের অন্যতম সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র দুর্গ বলে খ্যাত। একইসঙ্গে বিএনপির বিশাল ভোটব্যাংক হিসাবে বিবেচিত। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তিন মেয়াদে সপ্তমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখানে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।
সম্ভাব্য প্রার্থী যারা : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির তিন কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন চাইবেন। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম ফজলুল হক, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাবেক নেতা ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। এই তিনজনের মধ্যে তরুণ রাজনীতিবিদ মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের নাম বেশ আলোচিত হাটহাজারীসহ পুরো চট্টগ্রামে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। হাটহাজারী উপজেলা জামায়াতের আমির ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলামকে এই আসনে দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া এবি পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টসহ অন্য দলের প্রার্থীরাও সরব আছেন। আওয়ামী লীগের কেউ মাঠে নেই। চট্টগ্রাম-৫ আসনটি একটি পৌরসভা, ১৪টি ইউনিয়ন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা : চট্টগ্রাম-৫ আসনে নির্বাচনি এলাকায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে বিএনপি, জামায়াত ও এবি পার্টিসহ ছোট দলগুলো নানাভাবে কাজ শুরু করেছে। রমজানজুড়ে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ইফতার মাহফিল ও ইফতারসামগ্রী বিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে ভোটের মাঠ গোছানোর কাজ করছেন। ইসলামী দলগুলোর বেশ কিছু প্রার্থীকে মাঠে দেখা গেলেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের কোনো সাংগঠনিক বা দলীয় তৎপরতা নির্বাচনি এলাকায় নেই। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে জাতীয় নির্বাচনে কোনো নেতাকর্মী প্রার্থী হবেন না বলে নিশ্চিত করেছেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
যা বলছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা : বিএনপির অন্যতম মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধকালীন হাটহাজারী থানা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম ফজলুল হক। তিনি বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে ফজলুল হক বলেন, দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেছি। নীরবে-নিভৃতে সারা জীবন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। আমি কোনো পদের রাজনীতি করি না। শহিদ জিয়ার আদর্শ ও রাজনীতির যে রূপরেখা তা হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানুষের বাক-স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেই রূপরেখা বাস্তবায়নেই আমাদের অবিচল সংগ্রাম। শুধু বিগত ১৭ বছর নয়; বিএনপিকে একটি আদর্শিক ফাউন্ডেশন হিসাবে এলাকাভিত্তিক সুসংগঠিত করে গড়ে তুলতে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে কাজ করছি।
আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন রয়েছেন। সরকার পতনের আগে-পরে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন হাটহাজারীতে। জুলাই বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলোতেও অনুসারীদের নিয়ে মাঠে ছিলেন। তিনি হাটহাজারীতে বিভিন্ন ইউনিয়ন বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে যোগ দিচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিন সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার পাশাপাশি জনপদটি চষে বেড়াচ্ছেন। প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মীর হেলাল যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আমাকে মাঠের রাজনীতিতে তৎপর হতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম-৫ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে আমি দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা নিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন দলীয় নেতাকর্মী, সিনিয়র নেতা এবং আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা-হামলায় নির্যাতিতদের আইনি সহযোগিতা দিয়ে আসছি। দলের নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে ছিলাম, বর্তমানে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এলাকায় এলাকায় নেতাকর্মীদের নিয়ে লিফলেট বিতরণ করছি। এই আসনে আমার বাবা সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিনিধি হয়ে জনগণের ভোটে চারবার সংসদ-সদস্য ছিলেন। দল আমাকে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নমিনেশন দেয়, কিন্তু জোটগত কারণে অন্য এক প্রার্থীকে সুযোগ দেওয়া হয়। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন দলীয় নেতাকর্মী, সিনিয়র নেতা এবং হেফাজতে ইসলাম আলেমদের সর্বোচ্চ আইনি সহযোগিতা করেছি। এটি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসাবে মাঠে ব্যাপক দলীয় ও সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন দলের উপজেলা আমির ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম। মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। দলের দায়িত্বশীলরাও ব্যাপকভাবে তৎপর হয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জামায়াত একটি জনমুখী রাজনৈতিক দল। তাই নির্বাচন ঘিরে কার্যক্রম থাকা স্বাভাবিক। এর মধ্যে আবার যেহেতু প্রার্থীও নির্ধারণ হয়েছে, তাই আমরা নির্বাচন ঘিরে কাজ করছি।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. দিদারুল আলম এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, হাটহাজারী আসনে দলীয় প্রার্থী হব বলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মাঠে আছি। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছি। এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছি।
হাটহাজারী আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এম আবদুল ওহাব, ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে এবং জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে দলে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি), ১৯৯৬ (জুন) ও ২০০১ সালে বিএনপি থেকে সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম এমপি নির্বাচিত হন। জোটগত কারণে কল্যাণ পার্টির অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীককে ২০১৮ সালে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে পারেননি। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী জনগণ বেছে নিতে পারবেন-এমন প্রত্যাশায় বুক বেঁধে আছেন নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা।