
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৪০ এএম

শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে প্রচারিত আকাশবাণী অনুষ্ঠানে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় বাংলা সংবাদে বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।’ খবরটি শুনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমি তখন পশ্চিম পাকিস্তান বিমানবাহিনীর টেকনিক্যাল শাখায় কর্মরত। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম দেশে ফিরে যাব, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। তবে দেশে ফেরা ছিল অসাধ্য।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালিদের সব সময় নজরদারিতে রাখা হতো। কৌশলে ৮ জুন আমরা কয়েকজন করাচি থেকে ফ্লাইটযোগে দেশে ফিরতে সক্ষম হই। দেশে এসে ১৪ জুন চলে যাই এক নম্বর সেক্টরের অধীন হরিণা ক্যাম্পে। সেখানে মেজর রফিক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা আমাকে আগরতলা এয়ারফোর্সে পাঠিয়ে দেন। সেখানে কয়েকদিন ছিলাম। কিন্তু এয়ারফোর্সের কাজ পুরোপুরি শুরু না হওয়ায় আমি ফিরে এসে গেরিলা দলে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। পরে আমাকে চট্টগ্রাম শহরে বিশেষ কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
এফএফ গ্রুপের ১৩৭ নম্বর গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব নেওয়ার পর চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন অপারেশনে পাক হানাদারদের তৎপরতা থামাতে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধের পরিকল্পনা করা হলো। এর অংশ হিসাবে পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারি উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আশপাশের বাসিন্দাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে-এমন চিন্তা করে সেই পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমরা প্রায় ৩০ জনের একদল যোদ্ধা মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাবস্টেশনে আক্রমণ চালাই। এতে কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়। ওই অপারেশনে মান্নান নামে একজন পুলিশ সদস্য শহিদ হন। ৩০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম শহরের সব গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে যৌথ অপারেশন হয়। মূলত এটিই ছিল চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড় অপারেশন। ওই অপারেশনে তৎকালীন কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও পাঁচলাইশ থানার অন্তর্গত সব বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও পেট্রোল পাম্প একযোগে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ফলে শত্রুর পক্ষ বেকায়দায় পড়ে যায়।
তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল বাংলার আপামর মানুষের জনযুদ্ধ। যুদ্ধ করেছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির দামাল ছেলেরা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এই যুদ্ধকে ‘আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ’ মনে করে অস্বীকার বা বিরোধিতা করার মানসিকতা দেখাচ্ছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মনে রাখতে হবে, ’৪৭ হয়েছে বলে ’৭১ হয়েছে। আর যদি ’৭১ না হতো, তবে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান হতো না। কেউ যদি জন্মকে স্বীকার না করে-সেটা হবে দুঃখজনক। একজন সম্মুখসারির মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এই প্রজন্মের কাছে অনুরোধ থাকবে- ‘তারা যেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করে। জাতীয় স্বার্থে জনযুদ্ধকে যেন কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা না করে।’
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রুপ কমান্ডার