পাচারের অর্থের কিছু অংশ এ বছর ফেরানো সম্ভব: অর্থ উপদেষ্টা

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে বিপুল অঙ্কের পাচার হওয়া অর্থের কিছু অংশ চলতি বছরে দেশে ফেরত আনা সম্ভব। এ অর্থ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরাতে প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। মঙ্গলবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন আশার কথা শোনান। এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী জানান, অর্থ পাচারের গতি গোপন করতে সরকার জাতিসংঘে আমদানি-রপ্তানির ডাটা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান।
সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, পাচার হওয়া বিপুল অঙ্কের অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এ অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এ বিষয়ে আপনারা আগামী মাসে আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন। তিনি বলেন, পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনতে কতগুলো আইনি পদক্ষেপ আছে। আবার বিদেশের সঙ্গে এগুলো জড়িত। আমরা চেষ্টা করছি-এগুলো দ্রুত সুরাহা করতে।
এদিকে, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রচেষ্টা জোরদার করতে সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত সভায় তিনি এ নির্দেশনা দেন।
অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছয়টি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ‘মোংলা বন্দরের সুবিধাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পণ্য ক্রয় কার্যক্রমের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি)। এতে ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এতে চীন সরকার প্রকল্প ঋণ ৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা এবং সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৪৭৫ কোটি টাকা।
এছাড়া স্পট মার্কেট থেকে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৬৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এক কার্গো এলএনজি ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এতে প্রতি ইউনিটের/এমএমবিটিইউ দাম পড়বে ১৪ দশমিক ৩০ মার্কিন ডলার। এছাড়া বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (খুলনা বিভাগে) বৈদ্যুতিক বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ক্ষমতাবর্ধন শীর্ষক প্রকল্প প্যাকেজের আওতায় ৪৮ হাজার ৬০০টি এসপিসি পোল ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এতে ১৫৩ কোটি ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ২৪৯ টাকা ব্যয় হবে।
পাচারের গতি গোপন করতে জাতিসংঘে তথ্য দেওয়া বন্ধ করা হয় : অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী জানান, ২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘে (ইউএন) সরকার আমদানি-রপ্তানির ডাটা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
তিনি জানান, জাতিসংঘে থাকাকালে এটি আমার চোখে পড়ে। হঠাৎ তথ্য সরবরাহ বন্ধ করায় আমার ভেতর ঝড়ের সৃষ্টি হয়। কারণ ব্যবসা বাণিজ্যের অন্তরালে অর্থাৎ আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে। জাতিসংঘে প্রতিটি দেশের আমদানি-রপ্তানির তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কাউন্টার রেকর্ড মিলিয়ে দেখা যায়। অর্থ পাচার বন্ধে এ রেকর্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নয় বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের নীতিসংক্রান্ত ডেটা (তথ্য) শেয়ার করা বন্ধ রাখা হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। যে দেশে অর্থ পাচার হয়ে গেছে, সে দেশ সুবিধাভোগী। তারা সহজে অর্থ ছাড়বে না। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। ফলে অনেক দেশ নিজেরাই পাচারের অর্থ ফেরত দিতে সহায়তা করতে চাইছে। আমরা আন্তর্জাতিক সহায়তা পাচ্ছি।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশ বের হওয়ার মতো অবস্থানে আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অর্থনীতির সূচকগুলো পর্যালোচনা করবে। এলডিসি উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে যেতে অর্থনীতিসহ অন্যসব সূচক সঠিক দেখানো হয়েছে। এখন আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজার সুবিধা পাচ্ছি। এখনো তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশজুড়ে আছে। আমরা পোশাক শিল্পের বিকল্প তৈরি করতে পারিনি। ২০১৮ সাল থেকে বলা হচ্ছে-আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসব। ২০২৫ সাল চলছে-এ সাত বছরে পোশাক শিল্পের বিকল্প পণ্য তৈরি হয়নি।
এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ পিছিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে কিনা জানতে চাইলে বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এটি পুরোপুরি বাংলাদেশের হাতে নয়। তবে অধিকার আছে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন করার। আবেদনের সঙ্গে যৌক্তিক কারণগুলো দেখাতে হবে। অগ্রাধিকার কাজ কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উত্তরণে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, এশিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছিল। এর প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ কমেছিল। বাংলাদেশের জিডিপিতে এত প্রভাব না পড়লেও বিভিন্ন খাত ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না। রাজনৈতিকভাবে এ সরকারকে অন্তর্বর্তী বলা হচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগ করছে না।
এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে ফুলের শুভেচ্ছায় বরণ করে নেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক।