Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অগ্নিঝরা মার্চ

জনগণের রাজনৈতিক শক্তির উত্থান অবশ্ব্যম্ভাবী

Icon

আ ব ম নুরুল আলম

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জনগণের রাজনৈতিক শক্তির উত্থান অবশ্ব্যম্ভাবী

শেখ মুজিবুর রহমানের অন্তরে ছিল পাকিস্তানের শাসন। কিন্তু যুদ্ধের নেতৃত্বে তিনি এসে গেছেন ঘটনার পরিক্রমায়। যুদ্ধের নেতৃত্বদান করার মতো যোগ্যতা আওয়ামী লীগের ছিল না। একজন এমপিও যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল না। দু-একজনের অবস্থান যদিও ছিল তবে সেটা উদাহরণ হতে পারে না। ছাত্রলীগ দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একাংশের নেতৃত্বে ছিল ফজলুল হক মনি, অপর অংশে ছিল সিরাজুল ইসলাম। মার্চ মাসের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই গ্রুপকে এক করেন। এই দুই গ্রুপের বিরোধে ভারতে ট্রেনিং সেন্টার পর্যন্ত গড়িয়েছে। ভারতের আসামের হাফলং ট্রেনিং সেন্টারে দুই গ্রুপও বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবান তখন বলেছিলেন, আপনারা নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটলে আপনারা এগোতে পারবেন না। আপনারা যদি যুদ্ধে নাও যান তবুও ডিসেম্বরের সূর্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেখতে পারবে না।

প্রকৃতপক্ষে যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম ডিসেম্বরের বিজয়মালা আমাদের পরানো হয়েছিল সেটা তখনি খসে পড়ে গেছে। স্বাধীনতার স্বাদ আমরা এখনো পাইনি। স্বাধীনতার স্বাদ, স্বপ্ন, জনগণের জীবনমানের পরিবর্তন কিছুই হয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই ফ্যাসিস্ট। দুই দলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই। এখন জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনগণের শক্তি হিসাবে যেসব দল দু-একটি গড়ে উঠেছে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। আমরা এখনো স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে রয়েছি। বহুদিন থাকতে হবে। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নেতৃত্বে আসার চেষ্টা করছে। তারাই এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে চাচ্ছে। এমন একটি দুর্ভাগা দেশে আমরা জন্ম নিয়েছি।

আজ যারা ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছে যুদ্ধের ভয়াবহতা কেমন ছিল তারা জানেই না। আমি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে আসামের হাফলং ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিই। সেখান থেকে একযোগে ১৫০ জন ট্রেনিং নিয়ে সাতক্ষীরা দিয়ে দেশে প্রবেশ করি। তালা উপজেলার মাগুরা গ্রামে আমরা অবস্থান নিলাম। সেখান থেকে আমাদের ১৫-১৬ জন করে ভাগ করে পৃথক টিম করে দেন কমান্ডার কামরুজ্জামান টুকু। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দিতাম। মাগুরার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি টিমের ওপর পাটকেলঘাটার পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অবস্থানরত সৈনিকরা আক্রমণ করে। মাগুরা থেকেই আমরা গুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। পরিস্থিতি কেমন সে বিষয়ে খবর নিতে আবুল হোসেন নামে একজনকে পাঠালাম। আবুল সাইকেলে চড়ে বালিয়াডাঙ্গার কাছাকাছি গেলে পাক সেনাদের সহযোগী রাজাকাররা গুলি করে তাকে মেরে ফেলে। আবুলকে যখন মেরে ফেলার খবর পেলাম তখন শরীরের রক্ত যেন টগবগিয়ে ওঠে। আমি একা, আমার কাছে একটি মাত্র রাইফেল আর একশ রাউন্ড গুলি রয়েছে। সাতপাঁচ কোনো কিছু না ভেবে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। ধানখেতের মধ্য দিয়ে গিয়ে পেছন দিক থেকে গুলি করি। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তবে তা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের মনোবল ভেঙে দেয়। তারা ভেবে নেয় যে পেছনে হয়তো মুক্তিযোদ্ধারের বড় কোনো টিম রয়েছে। এক মুহূর্তের মধ্যে দিশেহারা হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আটকে রাখা মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় দ্রুত অবস্থান নিয়ে নেয়। রাজাকার এবং পাক সেনাদের ওপর চড়াও হয়। এতে দ্রুত পিছু হটে পাকিস্তানি সেনারা। পরে তারা গুলি করতে করতে পালিয়ে যায়। সেখানে ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। ঘটনাটি আমার যুদ্ধের সেরা স্মৃতি। একদিকে এতগুলো মানুষকে রক্ষা করার আনন্দ, অন্যদিকে আবুলের মতো একজন নির্ভীক মানুষের জীবনদান আমাকে বিমোহিত করে। একই চোখে আনন্দ ও বেদনার পানি। স্বজন হারানো এমন অসংখ্য স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে বেড়ায়। সেসব শহিদের আত্মত্যাগকে ক্ষমতাসীনরা করেছে ধূলিসাৎ। এই দেশে ফ্যাসিবাদের বাইরে জনগণের রাজনৈতিক শক্তি এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

যুগ্ম আহ্বায়ক, খুলনা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম