Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন কুসুম্বা শাহী মসজিদ

Icon

আনু মোস্তফা, রাজশাহী

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন কুসুম্বা শাহী মসজিদ

মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন নওগাঁর ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদ। প্রায় ৪৬৫ বছরের এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির পুরোটাই কালো পাথরে মোড়ানো। মসজিদের দেওয়াল, মিনার ও গম্বুজে নকশা খোদাই করা। মুসলিম স্থাপত্যের অপরূপ সৌন্দর্যের এই শাহী মসজিদটি মুসল্লিদের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। কুসুম্বা মসজিদ দেখতে প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন। বাংলাদেশের পাঁচ টাকার কাগজের নোটে মুদ্রিত ঐতিহাসিক মসজিদটিকে ঘিরে পর্যটনশিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘার বিশাল দিঘি। এটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল এবং অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই দিঘি খনন করা হয়েছিল। কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, ৫২ ফুট চওড়া। মসজিদের চারদিকের দেওয়াল ৬ ফুট পুরু। তার ওপর বাইরের অংশ কালো পাথর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেওয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর রয়েছে ছয়টি গম্বুজ। যা দুটি সারিতে তৈরি।

কুসুম্বা মসজিদ দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতির দিক দিয়ে কিছুটা ছোট। ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভেতর দুটি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনানা গ্যালারি বা নারীদের নামাজের ঘর। এখানে মহিলারা নামাজ পড়তেন।

এদিকে মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেওয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার কারুকার্য করা। এ কারুকার্যগুলো খুব উন্নত মানের। দক্ষিণ দিকের মেহরাব দুটি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি ছোট। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুটি করে দরজা ছিল। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি, যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশপথের একটু দূরে বাক্স আকৃতির এক খণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন।

জানা যায়, কুসুম্বা মসজিদ সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মাঝে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে মসজিদের মূল প্রবেশপথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয়, এই মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুর শাহের শাসনামলে ১৫৫৪ থেকে ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স প্রায় ৪৬৫ বছর। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামন দল ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন বলে কোনো ঐতিহাসিক সূত্র থেকে দাবি করা হয়।

রাজশাহী বিভাগীয় শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে ও নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলায় অবস্থিত কুসুম্বা শাহী মসজিদের অবস্থান। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক থেকে স্বল্প দূরত্বে কুসুম্বা মসজিদ পর্যন্ত যে কোনো যানবাহনে যাতায়াত করা যায় সড়কপথে।

সরেজমিন দেখা গেছে, মসজিদটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই নজরে আসে মসজিদের দেওয়ালজুড়ে থাকা প্রাচীন টেরাকোটার দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। মসজিদের মিহরাবে রয়েছে বিচিত্র ফুল, লতাপাতা, ঝুলন্ত শিকল ও মনোরম সব শিল্পকর্মের ছাপ। কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, চওড়া ৫২ ফুট। ছাদের ওপর রয়েছে গোলাকৃতির মোট ছয়টি গম্বুজ।

এদিকে মসজিদের ভেতরে প্রবেশের আগেই নজরে আসে মসজিদ চত্বরে রাখা বাক্স আকৃতির একটি বড় কালো পাথর। কথিত আছে, এক কৃষক হালচাষের সময় তার জমিতে এই পাথরটি দেখতে পেয়েছিলেন। বিশেষ এই পাথরটি লাঙলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙে যায়। ওই সময় পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবি লিপি রয়েছে। আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন লেখা রয়েছে পাথরের ওপর। তিনি তৎকালীন বাংলার শাসক, যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ।

অন্যদিকে কুসুম্বা মসজিদের প্রাচীরবেষ্টিত এ মসজিদের সামনেই রয়েছে ৭৭ বিঘা আয়তনের সুবিশাল এক দিঘি, যেটি এখনো মানুষের কাছে কুসুম্বা দিঘি নামে পরিচিত। বর্তমানে কুসুম্বা শাহী মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মসজিদের ভেতরে প্রবেশের পরপরই নজরে আসে কাজী মঞ্চ। কথিত আছে- এক সময় ওই আসনে বসেই বিচারকাজ পরিচালনা করতেন তৎকালীন বাংলার শাসকদের নিযুক্ত কাজী বা বিচারকরা।

জানা গেছে, মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি দেখতে কুসুম্বা শাহী মসজিদে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন মসজিদটি একনজর দেখতে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বেশি ভিড় হয় এখানে। বছরের দুই ঈদেও বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থীদের সমাগম হয় কুসুম্বা শাহী মসজিদ প্রাঙ্গণে। এ মসজিদকে কেন্দ্রসংলগ্ন এলাকায় করে গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে বহু দোকানপাট ও ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মসজিদটি সংস্কার ও উন্নয়নের অভাবে কিছুটা জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। মান্দার কুসুম্বা গ্রামের রায়হানুল হক জানান, বর্তমানে মসজিদের দেওয়ালে ফাটল দেখা গেছে। এগুলো মেরামত করা দরকার। প্রতিনিয়ত এখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আসেন ঘুরতে কিন্তু তাদের থাকার জন্য উপযুক্ত কোনো আবাসিক হোটেল বা ব্যবস্থা নেই। এখানে পর্যটন বোর্ডের একটি রেস্ট হাউজ আছে কিন্তু সেখানে বিদেশি পর্যটকদের থাকার জন্য উপযুক্ত নয়। তাদের রাজশাহী অথবা নওগাঁ শহর থেকে আসতে হয় ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদের মুয়াজ্জিন ইস্রাফিল হোসেন জানান, বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই দর্শনার্থীরা এই মসজিদ দেখতে আসেন ও নামাজ আদায় করেন। ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে প্রত্নত্বত্ত বিভাগ। প্রত্নত্বত্ত অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম বলেন, সম্প্রতি মসজিদের কিছু কিছু স্থানে নোনা ফাটল আমাদের নজরে এসেছে। কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যেই বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার কারণে এবার সেগুলো সংস্কার করা যায়নি। আগামী অর্থবছরে নতুন বরাদ্দ এলে সেটি সংস্কার করা হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম