Logo
Logo
×

শেষ পাতা

১৮০ দিনের বিচার হয় না ৫ বছরেও

নির্ধারিত সময়ে বিচার শেষের নজির নেই-মহিলা পরিষদ * বিলম্বের কারণ পদ্ধতিগত জটিলতা ও আইনগত দুর্বলতা

Icon

মহিউদ্দিন খান রিফাত

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৮০ দিনের বিচার হয় না ৫ বছরেও

দেশে সব ক্ষেত্রেই নারীর সক্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনই নানাভাবে সহিংসতার শিকারও হচ্ছেন তারা। কিন্তু নারী নির্যাতন মামলার বিচার ১৮০ দিনে শেষ করার কথা থাকলেও তা ৫ বছরেও শেষ হয় না। দেশে বর্তমানে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন আছে ৩২ হাজার ৯৭২টি মামলা।

সুপ্রিমকোর্টের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা বিচারাধীন মামলা ১ লাখ ৩১ হাজার ১৩৪টি। আর তদন্তাধীন মামলা ২০ হাজার ১৮৩টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে ১ হাজার ৬০৭ মামলা। এ ছাড়া ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে ৭ হাজার ১৬৬টি। ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কারণ জানিয়ে প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টে জমা দেবেন। আইনটি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাদের (পুলিশ) প্রতি নির্দেশও দেওয়া হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪০১ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ নারী। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২ জন ও খুন হয়েছেন ৩ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ৬ জন পুরুষ এবং নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩৫ জন পুরুষ। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২৩ নারী। যার মধ্যে মারা যান ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৭ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ৩৬ নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৭ জন। এ ছাড়া ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে মারা যান ৭ জন। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৪ জন নারী।

২০২৪ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় কমপক্ষে ৫৭৪ জন শিশু। এছাড়া বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় কমপক্ষে ৬৭০ জন শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩৪ জন শিশু, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২০২ জন শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৩৬ ছেলে শিশু।

মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ২ হাজার ৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৬৭ কন্যাশিশুসহ ৫১৬ জন। তার মধ্যে ৮৬ জন কন্যাশিশুসহ ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১৮ জন কন্যাসহ ২৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ৫ জন কন্যাসহ ৬ জন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে।

এ ছাড়াও ৫৮ জন কন্যাশিশুসহ ৯৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, এসব মামলায় অনেক সময় চার্জশিট দিতে দেরি হয়। আর চার্জশিট না দিলে তো মামলা শেষ হবে না। এ ছাড়া মামলা করে বাদী সাক্ষ্য দিতে আসে না। যার ফলে এসব এভাবে পড়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার আপস হয়ে যায়। যারা আপস করেন তাদের নিরুৎসাহিত করা উচিত। না হলে অপরাধীরা সুযোগ পেয়ে যাবে।

১৮০ দিনে বিচার শেষ হওয়ার নজির নেই : মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম যুগান্তরকে বলেন, যথাসময়ে বিচার না হওয়ার ব্যাপারে জবাব দেবে রাষ্ট্র। এর আগে নুসরাত হত্যায় সারা দেশে আলোচিত হয়েছিল। সে মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হয়েছিল। মাগুরার মেয়েটার ক্ষেত্রেও হয়তো এমনটা হবে। কিন্তু যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত হলে এটার কোনো মনিটরিং নেই। নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখাশোনা করা হয় না। এটা দেশের বর্তমান আইন অঙ্গনের কালচার। যার কারণে এ ধরনের অপরাধ হয়েই যাচ্ছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা অনেক বছর থেকে দেখছি নারী নির্যাতনের মামলা পর্যালোচনা বা মনিটরিং করার কোনো উদ্যোগ নেই। যদি কোনো উদ্যোগ হয়েও থাকে সেটার সঙ্গে নারী অধিকার সংগঠন বা মানবাধিকার সংগঠনের কাছে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। যদি মামলা ফলো করার ন্যূনতম উদ্যোগ থাকত তাহলে প্রসিকিউশনের মধ্যে সমন্বয় হতো। সঙ্গে নির্যাতনে ভুক্তভোগীর আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিপূরণের চেষ্টা হতো। তাহলে হয়তো এই চিত্রটা কম ভয়াবহ হতো।

বিচার বিলম্বের কারণ : সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খাদেমুল ইসলাম বলেন, বিচার বিলম্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত জটিলতা ও আইনগত দুর্বলতা রয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না করলে তার জন্য কোনো জবাবদিহিতা বা শাস্তির ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রে আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা, ডিএনএ পরীক্ষাসহ ডাক্তারি অন্যান্য পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে সময় লাগে। এরপর মামলা যখন বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে যায় তখন নানা চ্যালেঞ্জ থাকে। ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে অনেকে উচ্চ আদালতে যান। আবার ভিকটিমের যখন অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়, তখন অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে সাক্ষ্য দিতে আসে না। অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করেন। তখন বাদীপক্ষ মামলা বিলম্বিত করে আসামিপক্ষকে হয়রানি করার চেষ্টা করে। মামলায় পুলিশ সাক্ষীরাও যথাসময়ে আসে না। সাক্ষী হাজিরে প্রসিকিউশনেরও গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়। এসব দুর্বলতার সুযোগ অপরাধীরা নেওয়ার চেষ্টা করে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কথা বেশি, কাজ কম : নারী অধিকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো মামলার অগ্রগতি তদারকি করা, ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেওয়া এবং বিচার প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করার কথা। তবে বাস্তবে দেখা যায়, এসব সংগঠন মূলত সংবাদ সম্মেলন, প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমিত রাখছে।

এ বিষয়ে ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মনিটরিং বা ট্র্যাকিংরে দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের। বিশেষ করে যারা প্রসিকিউশন দেখছেন বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের। তারা কি কোনো ট্র্যাকিং করছেন? সেখানে তারা চাইলে নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, আইন সহায়তা সংগঠনের সাহায্য নিতে পারে। তারা কি তা করেছেন? এই ধরনের সংগঠন কিছু মামলা ট্র্যাকিং করে কিন্তু এখানে সমন্বয়ের সাংঘাতিক অভাব।

মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মুসলিম বলেন, ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে আমরা যে মামলা করি সেগুলো মনিটরিং করি। এ ছাড়া আলোচিত মামলা থাকলে আমরা মনিটরিং করি। কেউ যদি আমাদের সাহায্য চায় সেই মামলাগুলোতে সাহায্য করি এবং মনিটরিং করি। এর বাইরে আমরা মনিটরিং করি না।

ধর্ষণসংক্রান্ত আইন সংশোধনে ১০ দাবি : ধর্ষণ অপরাধে ভুক্তভোগী ব্যক্তির ন্যায়বিচার নিশ্চিতে ১৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট’ ১০টি দাবি জানিয়েছে। ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার এখনই’ সংক্রান্ত প্রচার শুরু হয়েছিল ২০১৮ তে। কিন্তু এতদিনেও তা আলোর মুখে দেখেনি।

এদিকে রোববার আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত ও ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের মামলার বিচার সম্পন্ন করতে হবে। এ মর্মে আইন সংশোধন করা হচ্ছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম