Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অগ্নিঝরা মার্চ

আমার কাছে কপিলমুনির যুদ্ধটা সবচেয়ে স্মরণীয়

Icon

মো. আবু জাফর

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমার কাছে কপিলমুনির যুদ্ধটা সবচেয়ে স্মরণীয়

মুক্তিযুদ্ধে আমি একাধিক স্থানে যুদ্ধ করেছি। গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বিভিন্ন স্থানে লড়াই করেছি। তবে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির যুদ্ধটা আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয়। এটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে আটকের পর ১৫৩ জন রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বৃহত্তর খুলনায় মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে আমরা অ্যাকশনে যেতাম। পাইকগাছার হাতিয়ারডাঙ্গায় বিএলএফ সদর দপ্তরে আমরা অবস্থান করতাম। স্থানীয় জনগণের ওপর নির্যাতন এবং সম্পদ লুটপাট করছে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের সদস্যরা-এমন খবর আমরা কয়েকদিন ধরেই পাচ্ছিলাম। একদিন শেখ কামরুজ্জামান টুকু ভাই আমাদের বললেন, কপিলমুনির বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প খুব শক্তিশালী দুর্গ। তবে যেভাবেই হোক-ওই ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সবাই মিলে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। নৌবাহিনী কমান্ডো লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদু (বীর প্রতীক), স ম বাবর আলী, অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ ও মোড়ল আব্দুস সালামের সঙ্গে আমরা পরামর্শ করলাম। ভারী অস্ত্রের মধ্যে আমাদের কাছে ছিল একটিমাত্র আরসিএল। যা দিয়ে রাজাকার ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এরপরও শুধু সাহসের ওপর ভর করে আমরা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হামলার পরিকল্পনা হলো। যুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক গাজী রহমত উল্লাহ দাদু নির্দেশ দিলেন চারদিক থেকে রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করতে। দক্ষিণ দিকের নিরাপত্তায় ছিলেন খুলনার কাস্টম ঘাটের অধিবাসী শেখ আব্দুল কাইয়ুম।

৭ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে তালা থানার কানাইদিয়া গ্রামের ওপর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল কপিলমুনি পৌঁছায়। তবে রাজাকাররা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তারাও প্রস্তুতি নেয়। এরই মধ্যে আরসিএল ভারী অস্ত্র দিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় ফায়ারটি করেন হাজি মহসীন রোডের অধিবাসী মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক খোকা। এ যুদ্ধে তিনি আহত হন। আজও তিনি সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। ৮ ডিসেম্বর দিনভর যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রূপসা উপজেলার মুছাব্বরপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন আনু ও সাতক্ষীরা আশাশুনির গোয়ালডাঙ্গার আনোয়ার উদ্দিন গাজী শহিদ হন। ৯ ডিসেম্বর রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এরপর কপিলমুনি মাঠে রাজাকারদের নিয়ে গণআদালত বসানো হয়। সেখানে তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। রায়ের পর সেখানেই ১৫৩ জন রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এসব স্মৃতি মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আমার তখন বয়স ছিল ২১ বছর। একটু দেরিতে এসএসসি পাশ করি। যুদ্ধ শুরু হলে দেশ ত্যাগ করে ভারতের মিলিটারি একাডেমি দেরাদুনের টান্ডুয়ায় যাই। সেখানে ৪৫ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ শেষে ব্যারাকপুর সেনানিবাস থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে দেশে প্রবেশ করে পাইকগাছা থানার পাতড়াবুনিয়া বিএলএফের হেডকোয়ার্টারে যোগ দেই।

সার্কিট হাউজের পাক ক্যাম্পে হামলা চালাই, গল্লামারি ও বৈকালী যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেই। বয়রা পুলিশ ক্যাম্পে ডামি যুদ্ধ (পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁকা ফায়ার) করে অস্ত্র লুট করি। এ রকম অসংখ্য স্মৃতি ভেসে বেড়ায় চোখের সামনে। জীবনের শেষ সময়ে এসে নানা বিষয় নিয়ে আফসোস হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সরকার গঠন করেনি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ পরিচালনা করলে দেশের মানুষকে সরকার পতনের মতো আন্দোলন করতে হতো না। সরকার হটাতে গণ-অভ্যুত্থান করতে হতো না। নিরীহ সাধারণ মানুষকে জীবন দিতে হতো না।

বৈষম্য রেখে পাকিস্তানিরা যেভাবে দেশ পরিচালনা করত ঠিক সেভাবে বৈষম্য রেখে দেশ পরিচালনা করা হয়। ঘুস দিয়ে ফাইল এখনো ছাড়াতে হয়। বৈষম্য বিলোপের উদ্দেশ্য নিয়ে ৫ আগস্টে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে তা বাস্তবায়ন হোক এই প্রত্যাশা করি।

মো. আবু জাফর, আহ্বায়ক, খুলনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম