Logo
Logo
×

শেষ পাতা

লিটারে ১৫ টাকা দাম বাড়ানোর অপেক্ষায় সিন্ডিকেট

লাইটার জাহাজে ভাসছে মজুত সয়াবিন তেল

রোজার আগে একদফা ভোক্তার পকেট সাবাড়, এখন আরেক দফায় বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে ফাঁদ পেতেছে মাফিয়াচক্র

Icon

চট্টগ্রাম ব্যুরো ও যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লাইটার জাহাজে ভাসছে মজুত সয়াবিন তেল

লিটারে ফের ১৫ টাকা দাম বাড়াতে অপেক্ষায় আছে সেই সিন্ডিকেট-চক্র। রোজার আগে সরকারিভাবে একদফা দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট সাবাড় করলেও বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক করেনি। এখন ঈদের আগে আরেক দফা বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে সেই মাফিয়াচক্র ফাঁদ পেতেছে। নতুন করে আমদানি করা ভোজ্যতেল বন্দরে খালাস করছে না। আমদানি করা তেল ‘মাদার ভেসেল’ থেকে ‘লাইটার জাহাজে’ আনলোড করছে। অবৈধভাবে মজুত করে বিপুল পরিমাণ তেল গভীর সমুদ্রে ভাসিয়ে রেখেছে। সরকারিভাবে নতুন দাম ঘোষণা এলেই এই তেল খালাস করে বাজারে ছাড়া হবে। বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

সয়াবিন তেলের পাইকারি বাজার রাজধানীর মৌলভীবাজার। বৃহস্পতিবার এ বাজারের দুইজন বড় তেল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা যুগান্তরকে জানান, বাস্তবে দেশে তেলের কোনো সংকট নেই। কোম্পানিগুলো এবার রোজায় সরকারিভাবে তাদের চাহিদামতো খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনি। তেলের বাজার নিয়ন্ত্রকারী প্রভাবশালী মহল প্রথমে চেয়েছিল লিটারে ২০ টাকা বাড়াতে। কিন্তু সরকার ৮ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটারের দাম নির্ধারণ করে দেয় ১৭৫ টাকা। এতে তারা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়। এজন্য এখন আবার লিটারে ১৫ টাকা বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। মূলত তাদের চাহিদা অনুযায়ী দাম না বাড়ালে বাজারে সরবরাহ লাইন কখনো স্বাভাবিক হবে না। তারা বলেন, বাজারে যে সয়াবিন তেলের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, এটি আসলে কৃত্রিম। বিপুল পরিমাণ তেল সাগরে বিশেষ কৌশলে মজুত করা হয়েছে। তাদের জানামতে, মাদার ভেসেল থেকে খালাস করে বিপুল পরিমাণ তেল লাইটার জাহাজে মজুত রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে পর্দার আড়ালে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে জড়িত। কিন্তু কেউ তা স্বীকার করবে না। ঈদের আগে লিটারে তেলের দাম বাড়ানোর পর ঠিকই এসব তেল খালাস করে সরবরাহ লাইনে ঢুকানো হবে। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লাইটার জাহাজকে গুদাম বানিয়ে পণ্যমূল্য যাতে বাড়াতে না পারে, সেজন্য ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়, সব ধরনের পণ্য বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে লোড করার পর লাইটার জাহাজগুলোকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দর সীমানা ত্যাগ করতে হবে। মাদার ভেসেলকে গুদাম বানিয়ে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, মূল্য বৃদ্ধি করা রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী বলেও উল্লেখ করা হয় ওই সার্কুলারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সার্কুলারই প্রমাণ করে লাইটার জাহাজে তেল মজুত করে রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, ৫/৭ বছর আগেও ১২ থেকে ১৪টি কোম্পানি তেল আমদানি করত। বর্তমানে তা ৪/৫টিতে নেমে এসেছে। কিন্তু কী পরিমাণ তেল প্রয়োজন, কী পরিমাণ তেল আসছে, তা মনিটরিং করতে ব্যর্থ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশন। অথবা মন্ত্রণালয় ও আমদানিকারকদের সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের বোঝাপড়া আছে। না হলে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ে তাদের এত উদাসীনতা কেন। তিনি বলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর তালাশ করলে তেল মজুতের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। 

বাংলাদেশ লাইটার শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি মোহাম্মদ নবী আলম বলেন, আমদানিকারকরা ভোগ্যপণ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য লাইটার জাহাজগুলো গুদাম বানিয়েছে। বছরের অন্যান্য সময় সীমিত পরিমাণে ভোগ্যপণ্যের আমদানি হওয়ায় আমদানিকারকরা দ্রুত পণ্য খালাস করতেন। এখন রমজান আসায় পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, পাশাপাশি আমদানিও অনেক বেড়েছে। তাই লাইটার জাহাজের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু জাহাজেই পণ্য মজুত করে রাখায় অন্যান্য পণ্য পরিবহণে সমস্যা হচ্ছে। 

লাইটার জাহাজসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১৮০০ লাইটার জাহাজ পণ্য পরিবহণ করছে। আমদানিকারকরা পণ্য খালাস না করে প্রায় ২০ শতাংশ লাইটার জাহাজকে গুদাম হিসাবে ব্যবহার করছেন। সেই হিসাবে প্রায় ৩৬০ লাইটার জাহাজ তাদের দখলে রাখায় নৌপথে সিমেন্ট, বালু, ক্লিংকারসহ অন্য পণ্য পরিবহণে গতি কমেছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ফের সরকারিভাবে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলো কারসাজি করছে। তেল সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক করছে না। তিনি জানান, মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য মজুত করে পরে গুদামে নেওয়া নিচ্ছে। এভাবে সময় পার করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। ঈদ ঘিরে এ সংকট কাজে লাগিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পাঁয়তারা করছে। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। ভোজ্যতেলের সংকট, দাম বৃদ্ধি ও ভোক্তাদের হাহাকার দেখে উদ্বিগ্ন ছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনও। এজন্য খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চার দফায় বৈঠক করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম। সর্বশেষ মঙ্গলবার টাস্কফোর্সের সভা করে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের ডিসি সতর্ক করে দেন। 

ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনষ্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম সময়ে সময়ে বৈশ্বিক বাজার ও অভ্যন্তরীণ খরচের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা। এখন তা ১৫ দিন পরপর সমন্বয় করার কথা। বৈশ্বিক বাজারে তেলের দর, আমদানি খরচ, পরিবহণ ও বিভিন্ন ধাপে সরকারের ভ্যাট যুক্ত করে সয়াবিন তেলের দর নির্ধারণ করা হয়। আমরা বলেছি সরকারের নীতিমালা মেনেই দর সমন্বয় করতে। তবে সরকার রোজায় পণ্যটির দাম বাড়াতে চাইছে না। সেজন্য রোজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাট ছাড় অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদার পরিমাণ ৩ লাখ টন। দেশে ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। এছাড়া দেশীয় উৎপাদন করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। আর আমদানি পর্যায়ে এখনো পাইপলাইনে আছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নিম্নমুখী হওয়ায় স্থানীয় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ট্যারিফ কমিশনের এ প্রতিবেদন অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী হওয়ার কথা। কিন্তু উলটো বাড়ছে।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম