Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বাসায় ইফতারে হাহাকার

আতর-তসবিহ পড়ে আছে, শুধু নাফিজ নেই

শিপন হাবীব

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আতর-তসবিহ পড়ে আছে, শুধু নাফিজ নেই

সব খুনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনো বেঁচে আছে। কিছু গ্রেফতার হলেও বিচার নিশ্চিত হয়নি। এদের ফাঁসি কখন হবে নিশ্চিত নয়। অপরদিকে ক্ষতিপূরণ নামক কিছু টাকাও আমরা পাচ্ছি। কিন্তু আমার কলিজার ধনকে (ছেলে) কি আর ফিরে পাব? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সব উপদেষ্টা এবং সমন্বয়কদের প্রতিশ্রুতিকে কাঠগড়ায় তুলে শহিদ সন্তানের ছবিটা ছুঁয়ে কান্নাভেজা গলায় এই প্রশ্নটাই ছুড়ে দিলেন অসহায় এক মা নাজমা আক্তার নাসিমা। তার ছেলে গোলাম নাফিজকে গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৪ আগস্ট বিকালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ক্ষোভ উগরে বললেন, সবার আগে খুনি হাসিনাসহ হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার সর্বোচ্চ বিচার সম্পন্ন করা হোক। তবেই তার শহিদ ছেলেসহ সব শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। বৃহস্পতিবার বিকালে ইফতার সামনে নিয়ে শহিদ গোলাম নাফিজের মা নাসিমা বললেন, আমার ছেলেকে গুলি করে ড্রেনে ফেলে দেয়। ওখান থেকে তুলে এক রিকশাচালক হাসপাতালে নিতে চাইলে ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী বাধা দেয়। রিকশাচালকসহ নাফিজের দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। চিরদিনের মতো ছেলেকে হারিয়ে নাসিমার বুকফাটা কান্নার সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল চড়া অভিযোগের সুর। কেননা প্রিয় ছেলে হারানোর যন্ত্রণার সঙ্গে ক্ষতিপূরণের কোনো অঙ্কই যে মেলে না।

রাজধানীর মহাখালীতে বৃহস্পতিবার শহিদ গোলাম নাফিজের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা শোকাহত অবস্থায় ইফতার তৈরি করছেন। কেউ কুরআন পড়ছেন, কেউ প্রার্থনা করছেন। শহিদ নাফিজ যে রুমটিতে পড়তেন-ঘুমাতেন, সেখানে তার ব্যবহৃত সবই রয়েছে। নেই শুধু নাফিজ। বই-খাতা, টুপি, আতর-সুরমাদানি, ফটো অ্যালবাম, কাঁথা-বালিশ, চেয়ার, কলেজের ড্রেস-সবই আগের মতো পড়ে আছে। প্রাণহীন ছবি ঝুলছে। শুধু নাফিজই রুমটিতে নেই। মেধাবী এ শিক্ষার্থী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, ধর্মীয় বই পড়তেন। বাসায় কিংবা আত্মীয়স্বজনদের বাসায় দোয়া-মাহফিল হলে নিজেই মোনাজাত করতেন।

গোলাম নাফিজ রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করে নৌবাহিনী কলেজ ঢাকায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর্মি অফিসার হবেন-এমন স্বপ্নে কলেজে ভর্তি হলেও খুনিরা তার সেই আশা পূরণ করতে দেয়নি। নাফিজের রুমে একটি বড় ব্যানার টানানো। ব্যানারে রিকশার পাদানিতে মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা রক্তাক্ত নাফিজের সেই ছবি ভাসছে। টেবিলের ওপরে থাকা ফটো অ্যালবামে অন্তত অর্ধশতাধিক ছবি ছিল। মা-বাবা, বড় ভাই গোলাম রাসেলের সঙ্গে তোলা ছবিগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। নাফিজকে জড়িয়ে ধরা ছবিগুলো রাসেলকে কাঁদায়।

গোলাম রাসেল বলছিলেন, নাফিজ আমার ২ বছরের ছোট। সে-ই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। একসঙ্গে ঘুমাতাম। মৃত্যুর মাস তিনেক আগে নাফিজ ড্রয়িংরুমে চলে আসে। ফ্লোরে একটি লেপ-তোশক বিছিয়ে একাই ঘুমাত। কলেজে ভর্তি হওয়ায় একা রুমে মনোযোগ দিয়ে শুধু পড়ত। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার পর থেকেই নাফিজ ব্যাকুল হয়ে উঠে। সে ১৭ ও ১৮ জুলাই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। ওই সময় পুলিশের রাবার বুলেটে সে আহত হয়। এরপর থেকে কিছুতেই ঘরে থাকতে চাইত না। ৪ আগস্ট সকালেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, ভাই আমি কিন্তু বের হলাম, তুমি চিন্তা করো না। কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বড় ভাই রাসেল। মা নাজমা আক্তার যখন টেবিলে ইফতার সাজাচ্ছিলেন তখন তার দুই চোখের অশ্রু পড়ছিল। জানালেন, গত রোজায় নাফিজ তার সঙ্গে ইফতার তৈরিতে সহযোগিতা করত। তার বড় ভাই-বাবাকে ইফতার তুলে দিত। এ রমজানে নাফিজ নেই। ইফতার গলা দিয়ে ঢুকে না। এখন তাদের পরিবারে ইফতার শুধু নামেই। কোনো আনন্দ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। নিজে অসুস্থ থাকলে নাফিজ ভাত রান্না করত। তার সেবাযত্ন করত। মেয়ে না থাকায় ২ ছেলেই বাসার প্রায় সব কাজ করত।

একপর্যায়ে শহিদ নাফিজের বেশ কতগুলো ছবি দেখিয়ে মা বলছিলেন, তার সন্তানকে গুলি করার পর পুলিশ ও হাসিনার গুন্ডাবাহিনী পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। তার ছেলে যখন রিকশার রডটা ধরে রেখেছিল, তখনো জীবিত ছিল। কিন্তু খুনিরা তার ছেলেকে কোনো হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে দেয়নি। তাকে গুলি করে বুকটা ছিদ্র করে ফেলে। চাঁদের মতো ছেলের নাক-মুখ থ্যাঁতলে দেওয়া হয়। এমন বর্বর হত্যাকাণ্ডের পরও খুনিদের বিচার এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।

বাবা গোলাম রহমান রিটন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তথা সমন্বয়কারীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন-তা যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়। বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। প্রত্যেক শহিদের কবর বাঁধাই করাসহ যথাযথ মর্যাদায় স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে সব শহিদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে হবে। এসব এখনো করা হচ্ছে না কেন-কিংবা বিগত ৭ মাসেও কেন করা হয়নি, এরও জবাব দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। ছেলে নাফিজের নামে সরকারিভাবে কোনো বিশেষ স্থাপনার নামকরণ দেখতে চান বাবা। একই সঙ্গে সব শহিদের নামে বিশেষ স্থাপনার নামকরণ চান তিনি।

গোলাম রহমান রিটন বলেন, আমি ‘জুলাই-২৪ শহিদ পরিবার সোসাইটি’র চেয়ারম্যান। আমরা এ সোসাইটির মাধ্যমে শহিদ পরিবারের উন্নয়নে কাজ করছি। এখানে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যা যা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শত শত শহিদসহ হাজার হাজার আহত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে এ বিজয়। এ বিজয়ের অগ্রনায়ক শহিদ ও আহত ছাত্র-জনতাই।

নাফিজের মামা আবুল হাসেম বললেন, মেধাবী নাফিজ ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আর্মি অফিসার হবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নৌবাহিনী কলেজে ভর্তি হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানে প্রতিটি অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল সে।

নাফিজের সঙ্গে কখনো বন্ধু, কখনো মায়ের মতো হয়ে চলতেন নাফিজের মামি শিক্ষিকা আফরোজা আক্তার সীমা। বললেন, নাফিজ যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলের শিক্ষিকা তিনি। নাফিজ বই কিনতে পছন্দ করত। দুজনই বই কিনতেন, পড়তেন। আর্মি অফিসার হয়ে দেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেবে-এমন গল্প বলত। সেই নাফিজকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বলতেই সীমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। যে কোনো মূল্যে খুনিদের শাস্তি সবার আগে নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম