চবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আলমগীর
দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক
ঢাকা-চট্টগ্রামে রয়েছে প্লট ফ্ল্যাট * পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি দুদকের তদন্ত

শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আলমগীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় একাধিক বহুতল ভবন ও ফ্ল্যাট এবং গাড়ি-বাড়ির মালিক হলেও এসব সম্পদ অর্জনে জ্ঞাত আয়ের কোনো উৎস তিনি দেখাতে পারেননি। এমনকি জন্মের আগে তার নিজের নামে জমি কেনার অবিশ্বাস্য দলিলও পাওয়া গেছে।
আলমগীরের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পাঁচ বছর পরও সেই অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি দুদক। সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে পুনঃতদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশনারও এক বছর পার হয়ে গেছে। মঙ্গলবার থেকে তার দুর্নীতির অনুসন্ধান নতুন করে শুরু করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুযায়ী মো. আলমগীর চৌধুরীর জন্ম ১৯৫২ সালের ১১ ডিসেম্বর। কিন্তু ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় তিনি একাধিকবার নিলামে সরকারি জমি কিনেছেন-এমন তথ্যসমৃদ্ধ দলিল রয়েছে ভূমি অফিসের রেকর্ড রুমে। অর্থাৎ জন্মের ৪ বছর থেকে ১৭ বছর আগেও নিজ নামে জমি কিনেছেন আলমগীর! মূলত স্বজনদের বঞ্চিত করতেই তার বাবা সৈয়দুল আলম চৌধুরীর নামে কেনা এসব জমিতে তিনি ভূমি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিজের নাম জুড়ে দেন। এতে যে জন্মের আগেই তার নামে জমি কেনার অবিশ্বাস্য দলিল সৃজন হয়ে যাবে সে বিষয়টি তিনি খেয়াল করেননি। আর এটি করতে গিয়েই তাকে এসব জাল-জালিয়াতি জন্য তিনটি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে আদালতে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে আলমগীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, তার যেসব সম্পদ রয়েছে তার হিসাব দুর্নীতি দমন কমিশনে দিয়েছেন। একাধিকবার তার পক্ষে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কেন আবার তদন্ত শুরু হচ্ছে তা তিনি বলতে পারবেন না। তবে তিনি নিজেকে সৎ দাবি করে বলেন, ‘পারিবারিক ও জমিজমার বিরোধের জের ধরে কাছের কিছু মানুষ আমার পেছনে লেগেছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি আছে-এটি দেখিয়ে হয়তো নতুন করে ফায়দা নিতে চাইছে। আমার মতো ৫ হাজার লোক দেশে সৎ থাকলে দেশে অনেক বদলে যেত।’ তিনি কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয় এবং যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন তা বৈধ পথেই অর্জন করেছেন বলে দাবি করেন।
আলমগীর চৌধুরীর যত সম্পদ : আলমগীরের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের সিকদারপাড়ায়। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের (সিটি করপোরেশন এলাকা) সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় ৪ দশমিক ৩৪ কাঠা এবং ঢাকার পূর্বাচলে ৭ দশমিক ৫ কাঠার দুটি প্লট আছে তার। সুগন্ধার প্লটটিতে তিনি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্লটের তথ্য গোপন করে আলমগীরের স্ত্রী খুরশীদা শিরিন সিডিএ থেকে কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় ৪ দশমিক ২৫ কাঠা এবং রাজউক থেকে ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় ৫ কাঠার প্লট নেন। ঢাকার উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর সড়কে ৭ তলাবিশিষ্ট ২০ নম্বর বাড়িটি আলমগীরের স্ত্রী খুরশীদার বলে জানতে পারে দুদক। দুদকে আয়-ব্যয়ের যে হিসাব আলমগীর দিয়েছেন তাতে চট্টগ্রামের সুগন্ধা আবাসিক এলাকার ৬ তলা ভবন ও গ্রামের দ্বিতল ভবন নির্মাণের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে কম দেখিয়েছেন বলে মনে হয়েছে দুদকের কাছে। ধানমন্ডি ৪/এ রোডের ৫০ নম্বর ভবনটিতে ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে তার। এছাড়া বনানী মডেল টাউনের ৭/বি সড়কের এইচ ব্লকে ৪০ নম্বর বাড়ির এ-৮ ফ্ল্যাটটি তিনি কিনেছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে দুদক। আলমগীর এটি কেনার দাম দেখিয়েছেন ৬২ লাখ ২৭ হাজার টাকা যা নিয়ে সন্দেহ দুদকের।
দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয়, ঢাকার উপপরিচালক (অনু. ও তদন্ত-৫) খান মো. মীজানুল ইসলাম ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর প্রদত্ত এক চিঠিতে আলমগীরের বিরুদ্ধে প্রদত্ত প্রাথমিক তদন্তের বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় (সজেকা) চট্টগ্রামের উপপরিচালক বরাবরে প্রদত্ত এ চিঠিতে বলা হয়, ‘পর্যবেক্ষণের আলোকে তথ্যসংগ্রহপূর্বক প্রমাণকসহ আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে পুনরায় প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ এ চিঠি প্রদানের এক বছর চার মাস অতিক্রান্ত হলেও পুনঃপ্রতিবেদন ঝুলে আছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় সজেকা, চট্টগ্রাম-১ এর উপপরিচালক সুবেল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, তিনি যোগ দিয়েছেন কিছুদিন আগে। তবে পরিচালক মহোদয় এ নথিটি একজন সহকারী পরিচালককে ‘এনডোর্স’ করে দিয়েছেন। সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, তিনি নিজেও একদিন আগে যোগ দিয়েছেন। তবে আলোচ্য নথিটি তিনি হাতে পেয়েছেন। আলমগীরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এখনো চলমান।
আলমগীর প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) থেকে ২০১৪ সালে অবসরে যান। ২০১৬ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসাবে চুক্তিভিত্তিতে এক বছর চাকরি করেন। ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এক বছরের চুক্তিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার হিসাবে যোগ দেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে আলমগীরের বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগ ওঠার পর তার পদত্যাগ চেয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেন। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট-পরবর্তী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আলমগীর চৌধুরী।