ইফতার বাজার
প্রথম দিনেই জমজমাট চকবাজার

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারে রোজার প্রথম দিনই ইফতারসামগ্রীর বাজার জমে উঠেছে। রোববার দুপুর থেকেই এই বাজারে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। নানারকম ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। অনেক দূর থেকেও এসব খাবারের সুভাস নাকে আসে। মুখরোচক এসব ইফতার কিনতে ভিড় করেন বহু ক্রেতা। এরই মধ্যে বিক্রেতারা হাঁকতে থাকেন, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভইরা লইয়া যায়, ধনী-গরিব সবাই খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়।’
বাজারটি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার সার্কুলার রোডে। প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এ ইফতার বাজার। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে আসেন চকের ইফতারির স্বাদ নিতে। এখানকার ইফতারসামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মুসাল্লম, বটিকাবাব, টিকাকাবাব, কোফ্তা, চিকেন কাঠি, শামিকাবাব, শিকের ভারী কাবাব, সুতিকাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, জিলাপি, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা, হালুয়া, হালিম, দইবড়া, সৌদি পানীয় লাবাং, কাশ্মীরি শরবত, ইরানি শরবতসহ প্রায় ১০০ ধরনের খাবার।
তবে এখানে বেশির ভাগ বিক্রয়কর্মীর মাথায় ক্যাপ বা হাতে গ্লাভসের বালাই নেই। অধিকাংশ খাদ্যসামগ্রীই খোলা। তবে দোকানিরা জানান, ইফতারের প্রায় সব আইটেমই টাটকা-গরম। ফলে এসব খোলামেলা না রেখে উপায় থাকে না। গরম থাকায় ঢেকে রাখা সম্ভব হয় না। তাছাড়া প্রায় প্রতিটি দোকানের পাশেই ইফতার তৈরি করা হচ্ছে। খাবারগুলো চুলা থেকে তোলার একটু পরই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই ঢেকে রাখার প্রয়োজন হয় না।
সরেজমিনে ভিনদেশিদেরও ইফতার ক্রয় করতে দেখা গেছে। ইরান থেকে আসা জাকারিয়া বিনতে ইফতি নামে তরুণী বলেন, এ বাজারের কথা শুনেছিলাম। তাই সরাসরি দেখতে এসেছি। শত শত মানুষ একসঙ্গে ইফতার কিনছে। আমরাও কিনেছি। এ যেন এক হৃদয়ের বাজার।
বিক্রেতা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’ ইফতারটি তার দাদা ফটিক চাঁন বিক্রি করতেন ব্রিটিশ আমলে। তারপর তার বাবা আব্দুল রশিদ বিক্রি করেছেন পাকিস্তান আমলে। এখন তার বয়স প্রায় ৭৭ বছর। তিনি বিক্রি করছেন প্রায় ৫০ বছর ধরে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এ ইফতারটিকে বলা হতো ‘শেখ চূড়ার ভর্তা’। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর থেকে নামকরণ হয় ‘বড় বাপের পোলায় খায়!’
মোহাম্মদ হোসেন বলেন, তার ছেলেরাও এ ব্যবসা করছেন। অন্য ব্যবসা থাকলেও দাদা ও বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ইফতার বিক্রি করছেন, ভবিষতেও ইফতার বিক্রি করবেন। এটা পারিবারিক ঐতিহ্য। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে যে ধরনের উপকরণ দিয়ে এ ইফতারটি তৈরি করা হতো, এখনো ওইভাবেই তৈরি করা হচ্ছে। ইফতারটি সব ধর্মের সব ধরনের লোকজন খেতে পারে। এখানে গরুর মাংস দেওয়া হয় না। মুরগি, কবুতর, খাসির মাংসসহ এগুলোর কলিজা দেওয়া হয়। তাছাড়া খাঁটি ঘিসহ প্রায় ১৭ প্রকার মসলা দেওয়া হয়।
পুরান ঢাকার বাহান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির বাসিন্দা শেখ ফরিদুল ইসলাম ফরিদ যুগান্তরকে বলেন, এখানকার খাবার খেয়ে কেউ অসুস্থ হয়েছে-এমন অভিযোগ পাওয়া যায় না। কারণ, বিক্রেতারা খুব আপন করে ইফতার তৈরি করেন। ওটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। ইফতারকে তারা সম্মান করেন।
দেড়শ বছর ধরে সুতিকাবাব বিক্রি করছেন হাজি রুস্তম সাহেবের পরিবারের সদস্যরা। রুস্তম সাহেবের ছেলে হাজি মাহবুব জানান, তার বাবা, দাদা, দাদার বাবারা এ সুতিকাবাব বিক্রি করতেন। তিনি বিক্রি করছেন ৬০ বছর ধরে। তিনি গরু-খাসির সুতিকাবাব বিক্রি করেন।
বিক্রেতারা জানান, সুতিকাবাব ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া টেংরি কাবাব ১০০ টাকা, শিক কাবাব ১২০-১৫০ টাকা, কাঠি কাবাব ৮০-১০০ টাকা। শাহি জিলাপি ৩৫০ টাকা কেজি, রসমালাই ও দই প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা, দুধসর ও পানতুয়া যথাক্রমে ৪৫০ ও ৫৫০ টাকা, ঘিয়ে ভাজা জিলাপি ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
প্রথম রমজানে চকবাজারের ইফতারির বাজার পরিদর্শন করে ভেজাল ও বাসি খাবার বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্যনামক একটি বেসরকারি সংগঠনের সদস্যরা। প্ল্যাকার্ড নিয়ে বেশ কয়েকজন সদস্য ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করছিলেন। সংগঠনটির সদস্য মো. ফয়সাল জানান, এখানে প্রচণ্ড ভিড়। অধিকাংশ খাবার খোলা বিক্রি হচ্ছে। তবে খাদ্যসামগ্রীগুলো খুব দ্রুত বিক্রি হচ্ছে। চুলা থেকে ওঠানোর মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তবু আমরা অনুরোধ করে যাচ্ছি খাবার ঢেকে বিক্রি করতে।
এদিকে পুরান ঢাকার বংশালের আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্ট, আল-নাসের, রায়সাহেব বাজারের ক্যাফে ইউসুফ, আল-ইসলাস, মতিঝিল ঘরোয়া স্টারও তাদের ইফতারির সম্ভার সাজিয়েছে। এসব দোকানেও ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরের কর্মকর্তা মো. আব্দুল জাব্বার মন্ডল বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ১০টি টিম মাঠে কাজ করছি। চকবাজার ইফতার বাজারে দ্রুতই অভিযান পরিচালনা করা হবে। আমরা চাই-শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যেন এখানকার খাবারের মান ভালো হয় এবং যথাযথ মূল্যে ইফতারি বিক্রি করা হয়।