ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও ছিনতাই-ডাকাতির প্রতিবাদ
রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
৭২ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে আলটিমেটাম * এভাবে চলতে থাকলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার চেয়ার রক্ষা হবে না

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে। রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পৃথকভাবে এসব কর্মসূচি পালিত হয়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও রাজধানীর আসাদগেট, জিগাতলা ও উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ছাত্র-জনতা।
শিক্ষার্থীরা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ছিনতাই, ডাকাতি, গুম ও খুনের সংখ্যা লাগাতার বৃদ্ধি পেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পক্ষ থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এ ধরনের ঘৃণিত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা না হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ : দেশব্যাপী ছিনতাই, হামলা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়া ও দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে সমাবেশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রোববার বেলা ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে এই প্রতিবাদ সমাবেশ করেন তারা।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিকুর রহমান সানি বলেন, দেশে হঠাৎ করে ধর্ষণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। সরকারের উচিত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা এবং শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে নিরাপদে বাঁচতে চাই। জীবনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দিতে হবে। ধর্ষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে অপারেশন ডেভিল হান্টের মতো ‘অপারেশন রেপিস্ট হান্ট’ শুরু করার কথা বলেন তারা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ : ধর্ষণের বিস্তার ও রাষ্ট্রের চলমান বিশৃঙ্খলায় সরকারের কার্যকর ভূমিকা না রাখার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ ও ‘শিক্ষার্থী ফোরাম’। রোববার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরে পৃথক ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করেন তারা। মিছিল দুটি ভাস্কর্য চত্বর থেকে শুরু হয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। বিক্ষোভ পরবর্তী সমাবেশে জবি ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব শান্তা আক্তার বলেন, দেশে ধর্ষণসহ চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সরকারকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না। সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো ছাত্র-জনতা রাজপথে ফের আন্দোলন করবে।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ বলেন, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে গুম হওয়া ব্যক্তির স্ত্রীকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এই অবস্থা চলতে থাকলে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থী ফোরামের ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে বাংলা বিভাগের ছাত্রী শতাব্দীকা ঊর্মি বলেন, সন্ত্রাসীরা যেন ফ্রি পাশ পেয়ে গেছে। প্রতিদিন ধর্ষণ, ছিনতাই, খুনের খবরে নাগরিকরা আতঙ্কিত। গণ-অভ্যুত্থানের সরকার যদি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা আন্দোলন : ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, ধারালো অস্ত্রের হামলাসহ দেশের চলমান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে বাড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে ‘নিরাপত্তা আন্দোলন’ কর্মসূচি করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী। বিক্ষোভ সমাবেশে এক শিক্ষার্থী বলেন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ প্রতিরোধে কঠোর হতে বলা হলেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। যেখানে-সেখানে ছিনতাই-ধর্ষণ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তার চেয়ার নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। প্রয়োজন হলে তাকে সরিয়ে নতুন কাউকে বসানো হবে। ফারহানা তাবাসসুম নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ঘরে-বাইরে কোথাও নারীরা নিরাপদ নন। ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে পাওয়া ২৪-এর বাংলাদেশ এভাবে চলতে পারে না। ব্র্যাক ছাড়াও ইউল্যাবের স্থায়ী ক্যাম্পাসে ‘লাগামহীন অপরাধের বিরুদ্ধে মানববন্ধন’ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ইডেন কলেজে বিক্ষোভ-মশাল মিছিল : ইডেন মহিলা কলেজের বকুলতলায় সকালে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। নতুন বাংলাদেশে কেউ যেন আর ধর্ষণের শিকার না হন, সেই দাবি জানান তারা। সমাবেশে শিক্ষার্থী সুমাইয়া সাইনা বলেন, যে নারীরা অভ্যুত্থানের সময় সম্মুখসারিতে থেকে ভূমিকা রেখেছেন, অভ্যুত্থানের পর দেখা যাচ্ছে, তারা ঘরে ও রাস্তায় নিরাপদ বোধ করছেন না। রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। শহিদ মিনারে ফুল কুড়াতে গিয়ে একজন শিশুকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। নারী তার প্রতিবেশীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন, বাসে ধর্ষিত হন। সমাবেশে রওনক জাহান তন্নী, স্মৃতি আক্তার ও তিলোত্তমা ইতিসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বক্তব্য রাখেন। একই দাবিতে সন্ধ্যায় ইডেন মহিলা কলেজে একটি মশাল মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা।
তিতুমীর কলেজে প্রতিবাদ সমাবেশ : তিতুমীর কলেজে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে আমরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সাক্ষী হয়েছি। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমরা এমন একটি সুন্দর রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে অপরাধ প্রবণতার অবসান ঘটবে। কয়েক দিন ধরে ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ২৪-পরবর্তী এ সময়ে বাংলাদেশে ধর্ষণের, ছিনতাইসহ সব অরাজকতার কোনো ঠাঁই হবে না। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। না হলে কঠোর কর্মসূচির দিকে আমরা ধাবিত হব।’
আসাদগেট ও জিগাতলায় বিক্ষোভ : সকাল ১০টার পর আসাদগেট এলাকায় সড়ক আটকে মিছিল করেন আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী। এ সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে যানজট তৈরি হয়। শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম আজম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আশপাশের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে তারা আটকে রাখা গাড়ি ছেড়ে সড়কের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর ২টার দিকে তারা সড়ক থেকে চলে যান।’
রোববার বেলা ১১টার দিকে নিউমার্কেট-মিরপুর সড়কের আসাদগেট এলাকায় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। অবরোধে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ আশপাশের এলাকার ছাত্র-জনতা অংশ নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, প্রথম দিকে আসাদগেটের পুরো সড়ক অবরোধ করা হয়। পরে তালুকদার ফিলিং স্টেশনের সামনের একপাশে অবস্থান নেন তারা।
উত্তরায় ছাত্র-জনতার মানববন্ধন : বেলা ৩টায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসংলগ্ন উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ করেন প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল এবং উত্তরা বিভাগ পুলিশের উপকমিশনার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করেন। বক্তারা ‘ধর্ষকের কালো হাত-ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, চব্বিশের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’ স্লোগান দেন।
সমাবেশে নাগরিক কমিটির নেতা মাহিন তালুকদার বলেন, একটা সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে চব্বিশের আন্দোলন হলেও ফ্যাসিবাদের নব্য দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাইছে। ঘৃণিত এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা বলেন। আইইএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সরদার রিয়াদ বলেন, ধর্ষকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ইউনিক রোড রয়েলস নামের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। বাসটি গাবতলী থেকে নাটোরের বড়াইগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা হলে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের হাইটেক সিটি পার্ক এলাকা অতিক্রমের পর বাসে যাত্রীবেশে ডাকাতরা যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে। এছাড়া ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ সব ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে মানুষ।