বিআরআইসিএম-এ কেনাকাটা
মালা খানের ২৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ
জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান * অনুসদ্ধান করছে দুদক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি

জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টসে (বিআরআইসিএম)। ২০১৮-২০২৪ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন প্রকল্প ও রাজস্ব খাতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক, আসবাবপত্র ও বাগান তৈরিসহ একাধিক দরপত্রে জালিয়াতি করে প্রায় ২৮ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। এসব অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সায়েন্স ল্যাব শাখার সভাপতি ও বিআরআইসিএম-এর সাবেক মহাপরিচালক মালা খানের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিআরআইসিএম-এ অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দুদকের অভিযান পরিচালনাকারী টিম মালা খানের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। এটি অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে যা শেষ করে প্রতিবেদন আকারে দাখিল করা হবে। এরপর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মালা খানের অনিয়মের বিষয়ে বিআরআইসিএম-এর প্রায় ৯০ ভাগ সায়েন্টিস্ট, কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ দিয়েছে। আমরা মালা খানসহ ৭০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। দুর্নীতির সত্যতাও মিলেছে। আশা করছি আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালা খান ২০১৮-২০২২ সালে বিআরআইসিএম-এ বাস্তবায়নাধীন ‘কেমিক্যাল মেট্রোলজি অবকাঠামো সমৃদ্ধকরণ’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ছিলেন। এ সময় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতি করে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া রাসায়নিক ক্রয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা, আসবাবপত্র ক্রয়ে পৌনে ২ কোটি টাকা এবং ভিটিএম উৎপাদন ও বিক্রয়ে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। মালা খানের দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ যুগান্তরের কাছে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, উল্লেখিত প্রকল্পের আওতায় সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) ২টি এইচপিএলসি (রাসায়নিক পৃথকীকরণ যন্ত্র) ও ৩টি অ্যাসিড ডিস্টিলেশন যন্ত্র ক্রয়ের অনুমোদন রয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে ১টি এইচপিএলসি ও ১টি অ্যাসিড ডিস্টিলেশন যন্ত্র কেনা হলেও পিসিআরে (প্রজেক্ট কমপ্লিশন রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন) ২টি এইচপিএলসি ও ৩টি অ্যাসিড ডিস্টিলেশন যন্ত্র ক্রয় দেখানো হয়। এভাবে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দরপত্রের মাধ্যমে ১টি অটোমেটেড ফিশ এনালাইজার (হিস্টোপ্যাথোলজি ল্যাবে ব্যবহৃত এক ধরনের অনুবীক্ষণ যন্ত্র) ৩টি অটোক্লেভ (নির্জীবকরণে যন্ত্র), ১টি ক্লিনিক্যাল র্যাপিড ফ্রিজার উইথ ক্রায়ো স্টেজ (ক্লিনিক্যাল স্যাম্পল সংরক্ষণ যন্ত্র) এবং বেশ কয়েকটি এয়ার কাটার, এয়ার শাওয়ার, স্মোক ডিটেক্টর কেনার নির্দেশনা ছিল। তবে এগুলো না কিনেই শুধু নথিপত্রে সরবরাহ দেখিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া ২০২১-২২, ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটে খুচরা যন্ত্রপাতি কেনার জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বাস্তবে এই খাতের অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ আছে, মালা খান প্রায়ই নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে দরপত্র পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আগেই সরঞ্জাম নিতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে অনুমোদিত ক্রয়-প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে শুধু মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেড এবং সিকদার এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে ১১টি যন্ত্র নেন। এসব যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে-রোটারি মাইক্রোট্রম, টিস্যু প্রসেসর, অটোমেটিক র্যাপিড কিট অ্যাসেম্বল মেশিন ইত্যাদি। তবে নানা অনিয়মের কারণে ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মালা খানকে অপসারণ করায় তিনি ওইসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সাজানো দরপত্র আহ্বান করতে ব্যর্থ হন। বর্তমানে পাওনা টাকার জন্য ঠিকাদাররা বিআরআইসিএম-এ ধরনা দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিকদার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আওয়াল সিকদার যুগান্তরকে বলেন, মেশিনগুলো মূলত মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেড চায়না থেকে আমদানি করেছিল। আমি শুধু কয়েকজন চাইনিজ প্রকৌশলী এনে সেগুলোর কমিশনিং করে দিয়েছিলাম। এ কাজে মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেডের সঙ্গে আমার সরাসরি ড্রিলিং (যোগাযোগ) হয়নি। এমনকি বিআরআইসিএম-এর মাধ্যমে মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেড পেমেন্ট (অর্থ পরিশোধ) দেয়। এছাড়া আমি বিআরআইসিএম’কে লোকালি (স্থানীয় বাজার) কিছু সরঞ্জাম দিয়েছিলাম। সেগুলো বাবদ বিআরআইসিএম-এর কাছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা পাব। মালা খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অপেক্ষা করতে বলছেন। অন্যদিকে মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেডের তত্ত্বাবধায়ক ফজলে রাব্বির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নয় বলে জানান। যদিও যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেডের দরপত্রগুলো ফজলে রাব্বি দেখভাল করে থাকেন।
রাসায়নিক কেনাকাটায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ : রাসায়নিক ক্রয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দরপত্রের মাধ্যমে ৪ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৯ টাকার কার্যাদেশ দেয় বিআরআইসিএম। মালা খান তার আরেক আস্থাভাজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘দ্য নেক্সট ফিউচার’-এর মালিক ফরিদুল ইসলাম ও ‘সাস করপোরেশনে’র মালিক সঞ্জয় সাহাকে কাজ পাইয়ে দেন। যদিও সে সময় ওইসব রাসায়নিকের আনুমানিক বাজারমূল্য ছিল ১ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ৭৫০ টাকা। এভাবে ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাসায়নিক ক্রয়বাবদ দরপত্র বাণিজ্য করে ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভিটিএম উৎপাদন ও বিক্রয় বাবদ ১৫ কোটি টাকার গরমিল : কোভিড মহামারিকালে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের জন্য বিআরআইসিএম ২২ লাখ পিস ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়া (ভিটিএম) তৈরি করে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে (২০২০ থেকে ২০২২) ৫টি দরপত্রের মাধ্যমে সর্বমোট ৩০ কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যের কাঁচামাল ক্রয় দেখানো হয়। নথিপত্র অনুযায়ী ৫টি দরপত্রই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘দ্য নেক্সট ফিউচার’ পায়। তবে বাস্তবতা হলো বিআরআইসিএম বিভিন্ন খুচরা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাঁচামালগুলো ক্রয় করেছে। বিআরআইসিএম-এর বিল ভাউচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২২ লাখ পিস ভিটিএম তৈরির কাঁচামাল কেনায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ ১৫ কোটি টাকা বেশি ব্যয় দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা লোপাট করা হয়।
জানতে চাইলে ‘দ্য নেক্সট ফিউচার’-এর মালিক ফরিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দরপত্রটি অনেক আগের। সঙ্গে একটি পার্টনার (অংশীদার) ছিল। দরপত্রের ক্ষেত্রে ইভ্যালুয়েশন (মূল্যায়ন) কমিটি থাকে। কমিটি সর্বনিম্ন মূল্যে কে কাজ করতে পারবে, ভেরিফাই (যাচাই-বাছাই) করে তাকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করে থাকে। দরপত্র পাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে সরঞ্জাম কিনে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। ভিটিএম ক্রয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি করোনাকালের ঘটনা। দরপত্র অনুযায়ী আমাদেরই কাঁচামাল কেনার কথা। অন্য কারও লোকালি কেনার কথা নয়। ওই সময় যে পার্টনার ছিল এখন তার সঙ্গে কাজ করছি না। ফলে তার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা ক্লিয়ার হতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরআইসিএম-এর একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আরও একটি দরপত্রের মাধ্যমে ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকার আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রে ২৪৫টি পণ্য কম সরবরাহ করে পৌনে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। খোলা চোখে দেখলে মনে হবে মালা খানের সময়ের সব দরপত্র প্রক্রিয়া খুবই স্বচ্ছ ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি বিভিন্ন খুচরা সরবরাহকারী কোম্পানি থেকে মালামাল সংগ্রহ করে পরে সাজানো দরপত্রে যন্ত্রাংশ এবং রাসায়নিক সরবরাহের পরিমাণ ও দাম বাড়িয়ে দেখান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মালা খান যুগান্তরকে বলেন, বিআরআইসিএম-এর প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী আমি। প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি দরপত্র হয়েছে যেগুলো মুখে বলা কঠিন। বিষয়টি নিয়ে দুদকে তদন্ত চলছে। তদান্তধীন বিষয়ে কথা বলা যৌক্তিক হবে না। তবে আমার জানামতে কোনো অনিয়ম হয়নি। কেনাকাটার জন্য ধাপে ধাপে কমিটি থাকে। তারা কাজ করে। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে অফিসে বসে ফাইলপত্র দেখে বলতে পারব।