সিলেট এমসি কলেজ
শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন শিবিরের
পায়ের রগ কেটে দেওয়ার চেষ্টা * তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি

সিলেট ব্যুরো, ঢাবি ও জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কুয়েটের ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর নাম মিজানুর রহমান রিয়াদ। তিনি কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শিবিরের নির্যাতনে আহত রিয়াদ এখন সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি আনজুমানে আল ইসলাহ নামের একটি দলের ছাত্র সংগঠন তালামীযে ইসলামীর কর্মী। সংগঠনটির নেতাদের দাবি-ছাত্রাবাসে সিট দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রশিবির। তবে, ছাত্রশিবির এমসি কলেজ শাখার সভাপতি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ঘটনা তদন্তে কলেজের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঘটনা জানতে চাইলে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে রিয়াদ বলেন, বুধবার রাতে খাবার শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় দরজায় প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ পান তিনি। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কলেজ ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জওহর লুকমান মুন্নার নেতৃত্বে ১০-১২ জন কর্মী রুমে ঢুকে লাথি দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দেয়। এরপর ফেসবুকে কুয়েটের ঘটনায় তুই শিবিরকে নিয়ে কী লিখেছিস বলেই তাকে চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুসি মারতে থাকে তারা। একপর্যায়ে পাশের রুম থেকে রড এনে নাজমুল ও সালমান নামের দুই কর্মী তাকে পেটায়। রুমমেট জুনেদ এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। দরজা লাগিয়ে কয়েক ঘণ্টা রড দিয়ে বেধড়ক নির্যাতন চলে তার ওপর। রিয়াদ অভিযোগ করে বলেন, তুই পরে যে অপবাদ দিবি, আগেই সেটি করে নিই-এই বলে শিবিরকর্মী আদনান ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পায়ের রগ কাটার চেষ্টা করে। রুমের বাইরে সহপাঠী জুনেদের চিৎকারে ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা দীর্ঘক্ষণ পর সেখানে এসে জড়ো হন। শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকলে শিবিরের নেতাকর্মীরা রক্তাক্ত অবস্থায় রিয়াদকে রুম থেকে টেনে বের করে ফেলে চলে যায়। তাকে পুলিশে দেওয়ারও হুমকি দেয়। এরপর শিবিরের সেক্রেটারি বলে ওঠেন, সে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, পুলিশে দেওয়ার দরকার নেই। মার যা দেওয়ার যথেষ্ট হয়েছে। আর যাতে সে ছাত্রাবাসে উঠতে না পারে। ছাত্রাবাস ত্যাগের সময় তারা কক্ষটিতে তালা দিয়ে রিয়াদ ও জুনেদের মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে চলে যায়।
এ বিষয়ে এমসি কলেজ শাখার তালামীযে ইসলামের সভাপতি আলবাব হোসেন জানান, এই হামলা শুধু ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে নয়। ছাত্রাবাসে যাতে ভিন্নমতের কেউ থাকতে না পারে সেই চেষ্টা করছে ছাত্রশিবির। এই হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন তিনি। তবে ছাত্রশিবির কলেজ শাখার সভাপতি ইসমাইল খান বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টিই ছাত্রশিবিরকে হেয় করার জন্য অপপ্রচার। এখানে শিবিরের কেউ নির্যাতন চালায়নি। হৃদয় নামের এক জুনিয়রের সঙ্গে রিয়াদের হাতাহাতি হয়। সে ঘটনায় সে আহত হয়। বরং এ ঘটনা জেনে ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি সেখানে গিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। তিনি আরও বলেন, তালামীযে ইসলাম মূলত ছাত্রলীগের বি টিম। তাদের দলের নেতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করে সংসদ-সদস্য (এমপি) হয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, পুরো ঘটনা হাসপাতালে গিয়ে পালটানো হয়েছে।
এ বিষয়ে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল আনাম রিয়াজ জানান, ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। ইতোমধ্যে ঘটনা তদন্তে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (মিডিয়া) বলেন, নির্যাতনের ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।
ঐক্য নষ্ট করতে ‘গুপ্ত সংগঠন’ উঠেপড়ে লেগেছে- ছাত্রদল : গত আগস্টে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট করতে একটি ছাত্র সংগঠন উঠেপড়ে লেগেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস। বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাস চত্বরের পাশে এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। সিলেট এমসি কলেজের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। মিছিলটি ঢাকা বিশ্বিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিণ করে ডাস চত্বরে এসে শেষ হয়। মিছিল পরবর্তী সমাবেশে সাহস বলেন, সিলেটে এমসি কলেজের ঘটনা দেখে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আবরার ফাহাদের কথা মনে পড়ে। বুকে রক্তক্ষরণ হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর একদল উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ বেশ ধরে লাঞ্ছনা ও হামলা করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ : সিলেটের এমসি কলেজের শিক্ষার্থীর ওপর ছাত্রশিবিরের মারধর ও রগ কাটতে চাওয়ার অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময় হামলায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে এ দাবি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘ক্যাম্পাসের ত্রাস খ্যাত ছাত্রলীগকে ৫ আগস্টের সময় বিতাড়িত করেছিলাম। আমরা ৫ আগস্টের পর দেখেছি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবারও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালু করছে। গতকাল দেখেছি সিলেটের এমসি কলেজের শিক্ষার্থীর ওপর শিবির হামলা চালিয়েছে। গত পরশু কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদল হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের হামলা-সন্ত্রাস শিক্ষার্থীরা আর দেখতে চাই না।’
জাবিতে বিক্ষোভ : সিলেটের এমসি কলেজের শিক্ষার্থীর ওপর শিবিরকর্মীদের মারধরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে হামলায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে মিছিল শুরু হয়। পরে তা শহিদ মিনার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনের রাস্তা ঘুরে পুনরায় বটতলায় এসে শেষ হয়। এ সময় একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী সুয়াইব হাসানের পরিচালনায় বক্তারা বক্তৃতা করেন।