অকার্যকর ঢাকা ওয়াসার পয়োবর্জ্য লাইন
সেবা ছাড়াই বিল আদায় ৩৮৩৪ কোটি টাকা

ফাইল ছবি
অকেজো হয়ে রয়েছে ঢাকা ওয়াসার পয়োবর্জ্য লাইনগুলো। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ৫ শতাংশও সেবা দিতে পারছে না সংস্থাটি। এরপরও পয়োনিষ্কাশন সেবা বাবদ বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক বিল আদায় করা হচ্ছে। পানির সঙ্গে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন সেবা বিলও। এভাবে গত ১৪ বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৩৮৩৪ কোটি টাকা জোরপূর্বক আদায় করেছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞ, গ্রাহক ও ঢাকা ওয়াসাসংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, আইনের ফাঁদে ফেলে নগরবাসীকে জিম্মি করে সেবাবহির্ভূত অর্থ আদায় করছে ঢাকা ওয়াসা। পাশাপাশি পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর কোনো সিস্টেম না থাকায় নর্দমা, খাল ও নদীতে পড়ছে সেসব। এতে অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য পানি ও পরিবেশ দূষণ করছে। যার প্রভাবে নানা রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী। এরপরও গ্রাহক ঢাকা ওয়াসার বিল থেকে কোনো ছাড় পাচ্ছেন না। এ অবস্থা উত্তরণে বর্তমান প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন লাইন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব বিভিন্ন ডকুমেন্টসে তা উল্লেখ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও সেবা না দিয়ে বছরের পর বছর অর্থ আদায় করা অন্যায়। তিনি বলেন, অবাক করা বিষয় হলেও সেবা না দিয়ে অর্থ আদায়ের পাশাপাশি পানির বিলের সমপরিমাণ স্যুয়ারেজ বিলও বাড়ানো হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা নগরবাসীর ওপর অন্যায়; ঢাকা ওয়াসাকে এখান থেকে সরে আসতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পয়োনিষ্কাশন লাইনগুলো পুরোনো এবং অনেকাংশে হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য নতুন একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কতটুকু সেবা দেওয়া যাচ্ছে তা যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। এরপর বিল আদায় করা হবে, না তা বন্ধ রাখা হবে সে বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা মহানগরীর ২০ ভাগ এলাকা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় ছিল। যথাযথ অঙ্গীকার, পর্যবেক্ষণ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে পয়োবর্জ্য বাসাবাড়ি বা অফিস থেকে সরাসরি নিকটবর্তী ড্রেনেজ লাইনে যাচ্ছে। কোথাও আবার সারফেস (খোলা ড্রেন) ড্রেনেও ফেলা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটা খাল, লেক, নদীতে মিশছে। রাজধানীর নদ-নদী, খাল ও জলাশয় দূষণের এটিও বড় কারণ।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০২২-২০২৩ এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পয়োনিষ্কাশন খাতে অর্থ বরাদ্দ এবং আয়ের হিসাব বের করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে-ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-১ এ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে সরকার পয়োনিষ্কাশন রক্ষণাবেক্ষণ খাতে খরচ করেছে ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ আয় হয়েছে ৪৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে আয়ের তুলনায় খরচ হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। তবে অকার্যকর পয়োনিষ্কাশন লাইনগুলোকে সচল করতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রকল্প-২ নামে স্যুয়ারেজ অবকাঠামো নির্মাণ ও পুনঃস্থাপন নামে ২০১০ সালের জুলাই থেকে জুন ২০১৫ মেয়াদকাল পর্যন্ত ৯১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা খরচ করে। তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং সেসব অর্থ এক প্রকার জলে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এতে ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তিনটি পয়োবর্জ্য পরিবহণের প্রধান পাইপ লাইন বা ট্রাঙ্ক স্যুয়ারেজের মাধ্যমে পাগলা পয়োশোধনাগারে পৌঁছাত। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের লাইনটি মোহাম্মদপুরের আসাদগেট থেকে শুরু হয়ে তেজগাঁও, মধুবাগ, বাসাবো, সায়েদাবাদ হয়ে পাগলা পয়োশোধনাগারে গিয়েছে। আরেকটি ট্রাঙ্ক স্যুয়ারেজ মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি থেকে শুরু হয়ে হাজারীবাগ, নিউমার্কেট, আরামবাগ, মতিঝিল হয়ে গিয়েছে পুরান ঢাকার নারিন্দা। পুরান ঢাকার সেকশনে নবাবগঞ্জ থেকে আরেকটি ট্রাঙ্ক স্যুয়ারেজ লাইন লালবাগ, টিপু সুলতান রোড হয়ে নারিন্দা গিয়েছে। ঢাকা ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যানে এসব ট্রাঙ্ক স্যুয়ারেজ লাইন অকার্যকর বলা হয়েছে।
তারা আরও জানান, এই মাস্টারপ্ল্যানে যা বলা হয়েছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। গ্রাহকের কাছ থেকে পয়োবর্জ্য স্যুয়ার লিফট স্টেশনে পৌঁছায় না। পয়োবর্জ্যরে একটি স্যুয়ার লিফট স্টেশন থেকে অন্য লিফট স্টেশনে পৌঁছায় না। ১৯৮৮ সাল থেকে হাতিরঝিলে মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, গুলশান, বনানী এলাকা পাগলা পয়োশোধনাগার থেকে বিচ্ছিন্ন। ২০০২ সালে ধোলাইখালে বক্স-কালভার্ট নির্মাণের সময় পাগলা পয়োশোধনাগারে যাওয়ার মূল ট্রাঙ্ক স্যুয়ারেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে স্যুয়ার লিফট স্টেশন ছিল ২৮টি এবং বর্তমানে ২১টি বলে ঢাকা ওয়াসা দাবি করছে; বাস্তবে এগুলো প্রায় অকার্যকর।
তারা বলেন, নিজেদের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে অকার্যকর দেখিয়ে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ২০২০ সালের নতুন প্রকল্প অর্থাৎ ঢাকা স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। এ প্রকল্পের আওতায় পাগলা পয়োশোধানাগারে পুনর্নির্মাণ এবং পাগলা ক্যাচমেন্টের ৪৬২ কিলোমিটার পয়োনিষ্কাশন নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়। প্রকল্পের মেয়াদকাল দেখানো হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম সংশোধনীতে খরচ বাড়িয়ে ৫১৮৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা করা হয়। পাশাপাশি মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৮ সালের এপ্রিল করা হয়েছে। সেই সময়েও এর কাজ শেষ হবে কিনা, তা বলা যায় না। ওই প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি শূন্য।
ঢাকা ওয়াসার বার্ষিক অডিট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে পয়োনিষ্কাশন বিল আদায় করেছে ১১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৩৩ কোটি ১০ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৬৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯২ কোটি ৪২ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২০৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৩৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৭৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩০৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৩৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৯১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০২০-২২ অর্থবছরে ৪৩৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৭৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানান, ঢাকা ওয়াসার মোট এলাকার মধ্যে ১, ২, ৩, ৫ এবং ৬ নম্বর পয়োনিষ্কাশন লাইন আছে। এর মধ্যে মডস জোন-১ এর আওতায় ২১৫ কিলোমিটার, মডস জোন-২ এর আওতায় ১৬৫ কিলোমিটার, মডস জোন-৩ এর আওতায় ১৬০ কিলোমিটার, মডস জোন-৫ এর আওতায় ১৮৮ কিলোমিটার এবং মডস জোন-৬ এর আওতায় ২০৬ কিলোমিটার বা মোট ৯৩৪ কিলোমিটার পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন লাইন গড়ে তোলা হয়। কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরোনো এই পয়োবর্জ্য লাইনটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য-এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) একেএম সহিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন-পয়োবর্জ্য লাইনগুলো অনেকাংশে অকেজো হয়ে পড়েছে সত্য। পাগলা পয়োশোধনাগার চালু রয়েছে। সেখানে তো টিউবওয়েলের বিশুদ্ধ পাশি শোধন করা হচ্ছে না। ড্রেন লাইন দিয়ে যেসব কালো পানি যাচ্ছে সেগুলো শোধন হচ্ছে। এতেও কিছুটা কাজ হচ্ছে।
এ সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন-পাকিস্তান আমলে ঢাকা শহরে কিছু এলাকায় স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণ করা হয়; যার সিংহভাগই এখন অকেজো । ফলে মানুষের পয়োবর্জ্য সিটি করপোরেশনের সারফেস ড্রেন ও স্ট্রম ড্রেনেজে পড়ছে। সেসব নদ-নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ তৈরি করছে। ঢাকা ওয়াসার পুরো রাজধানীর জন্য সমন্বিত স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। তিনি জানান, অনেক পুরনো এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঢাকা ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইনগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কোনো সেবা না দিয়ে জোরপূর্বব বিল আদায় করা কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। বিষয়টি বর্তমান ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে।