মহান ভাষার মাস
বইমেলা জন্ম দিক লাখো আবু সাঈদ

প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: জুথি মারিয়া
‘অমর একুশের বইমেলা’ আমাদের ভাষাশহিদদের গভীর দেশপ্রেমের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে। এ মেলাটির সঙ্গে অন্য যে কোনো মেলার সুস্পষ্ট চেতনাগত পার্থক্য রয়েছে। একথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
বইমেলা বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর তারুণ্যের মেলা-দেশপ্রেমের চেতনায় সর্বজনীন উৎসবের মহত্তর আয়োজন।
বইমেলা শিক্ষা-সংস্কৃতি-সামাজিক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ রচনার মেলা। ফলে এ মেলা আমাদের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব, গতানুগতিক আমোদ-প্রমোদের আয়োজন নয়। বিষয়টি আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন, উপলব্ধিতে রাখা প্রয়োজন।
ভাষাশহিদরা এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান-তাদের আত্মত্যাগের সোপান বেয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন-স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি আমরা। শত শহিদ, লাখো শহিদ, আর সহস্র শহিদের অপরিমেয় দেশপ্রেম আত্মবলিদানে এদেশে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সার্বভৌম দেশ পেয়েছি-প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সর্বশেষ জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার সহস্র সহস্র শহিদের রক্তস্নাত সর্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকার।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ গঠনের। যে স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল কর্তৃত্ববাদী অবৈধ শাসন। গণতন্ত্রকে নানা ছলে হত্যা করে যে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল, তাকে সরাতেও আমাদের আবারও রক্ত দিতে হয়েছে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। আমাদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের সাহসের প্রেরণা কালে কালে জ্বলে ওঠে একুশের মহান শহিদদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকেই। এজন্যই বইমেলা আমাদের আত্মার গভীরতর শেকড়। আমাদের এ শেকড় উপড়ে নেওয়া যায় না। তাই স্বাধীন দেশে গত ৫৫ বছরের ইতিহাসে যারাই স্বৈরশাসক হতে চেয়েছে, তাদেরই পতন ঘটেছে-এদেশের আবু সাঈদরা অকুতোভয়ে নিরস্ত্র দুহাত প্রসারিত করে ঘাতকের বন্দুকের গুলিকে বুক পেতে আহ্বান করেছে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ স্বদেশের মানুষের মুক্তির চেতনায়।
২.
আমরা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহব্যাপী আয়োজন করেছি একুশের বইমেলা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক সমর্থনে। আমরা চাই ভাষা আন্দোলনের শহিদ, মুক্তিযুদ্ধের শহিদ এবং এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগণন শহিদের আত্মত্যাগের ইতিহাস এবং গৌরব যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাণে সঞ্চারিত হয়।
আমি মনে করি, আমাদের এই ‘আবু সাঈদ বইমেলা’র মতো বইমেলা দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করুক। আয়োজন করুক দেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও স্কুলগুলো-আমাদের শিক্ষার্থী, সন্তানরা ইতিহাস, ঐতিহ্যকে জানুক বইমেলার এসব আয়োজন থেকে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করতে পারে। এটা সারা দেশে করা সম্ভব হলে আমাদের দেশে সঠিক পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতিচর্চার দ্বার উন্মুক্ত হবে, যা জাতির আগামী প্রজন্মকে ঋদ্ধ করবে, আলোকিত করবে, সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলবে। বিষয়টি আমি দলমতনির্বিশেষে বিবেকবান সব অভিভাবককে ভাবতে বলি।
বিচ্ছিন্নভাবে, একা একা একটা ভালো কাজকে বেশিদূর এগিয়ে নেওয়া যায় না, আমরা যদি সবাই মিলে একত্রে কাজ করি, তাহলে অবশ্যই আমাদের ভালো উদ্যোগ সবার কল্যাণ বয়ে আনবে।
৩.
ফাল্গুনে আমাদের বসন্তের সূচনা। আমাদের ভালোবাসায় কোনো ক্লেদ নেই; আমাদের ভালোবাসার মর্মমূলে আছে স্বদেশচেতনা। এ চেতনার সঙ্গে হয়তো ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র ভালোবাসার পার্থক্য আছে; তাই এ পার্থক্যকেও আমাদের বুঝতে হবে। গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানো নয়, সচেতনভাবে ভালো-মন্দকে জানতে হবে, বুঝতে হবে-বেছে নিতে হবে। অন্ধতা অসচেতনতা নয়, আমরা যেন সচেতন থাকি, চক্ষুষ্মান থাকি।
৪.
বইমেলাকে বইপাঠের উৎসব করে তোলার জন্য আমি মনে করি, উপজেলায় উপজেলায়ও ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা যখন দেশের প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আবু সাঈদ’-এর আত্মত্যাগকে স্মরণ করছি, তেমন বাংলার প্রতিটি শহরে, গ্রামে অসংখ্য দেশপ্রেমিকের স্মৃতি রয়েছে-বইমেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা যেন দেশপ্রেমের, আত্মত্যাগের সেই ইতিহাসকে জাগিয়ে রাখি-এটাই আন্তরিক আমার চাওয়া।
লেখক : উপাচার্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর