গ্রেফতার দুই এসপির নানা কীর্তিকলাপ
সিটিটিসিতে বদলি হয়ে কপাল খুলে যায় এসপি মান্নানের
ওসি বদলিতে ২০-৩০ লাখ টাকা নিতেন এসপি মান্নান, ছাত্রলীগকে নিজ কার্যালয়ে অস্ত্র রাখার সুযোগ দেন

সিলেট ব্যুরো ও বাগেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেফতার চার পুলিশ কর্মকর্তার নানা অপকীর্তি একের পর এক বেরিয়ে আসছে। তারা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অন্ধভাবে কাজ করে গেছেন। বিনিময়ে নিয়েছেন দামি পোস্টিংসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। বদলি বাণিজ্য, জমিদখলসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। এর মধ্যে গ্রেফতার হওয়া সিলেটের সাবেক পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান ও বাগেরহাটের সাবেক পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত সম্পর্কে জানা গেছে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসপি আব্দুল মান্নান ওসি পোস্টিংয়ে নিতেন ২০-৩০ লাখ টাকা। পুলিশ ফাঁড়িতে ইনচার্জ বদলিতে নিতেন ১০ লাখ টাকা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগকে নিজ কার্যালয়ে অস্ত্র রাখার সুযোগ দেন তিনি। অন্যদিকে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে একতরফা ভোটকে নির্বিঘ্ন করতে বলেছিলেন-কেউ ঝামেলা করলে একটি ব্যালটের জন্য একটি বুলেট খরচ করা হবে। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সিলেটের পুলিশ সুপার ছিলেন সদ্য গ্রেফতার হওয়া আব্দুল মান্নান। ৪ আগস্ট সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ৬ জন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গোপনে সিলেট ছাড়েন এসপি মান্নান। তার সম্পর্কে পুলিশের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, আব্দুল মান্নানের কপাল খুলে যায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমে (সিটিটিসি) বদলি হয়েই। সেখানে যোগদান করে মন জয় করে নেন সে সময়ের সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলামের। সে সময় গাজীপুরের কিছু লোকজন তার কাছে আসেন তাদের জমিজমার বিরোধ নিয়ে সমাধান চাইতে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নেন সেই জমি। সেখানেই গড়ে তোলেন ‘শালদহ ইকো-রিসোর্ট’। সঙ্গে নেন সরকারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে। যাদের অনেকেই এখন সচিব। সিটিটিসি থেকে মনিরুলের আশীর্বাদপুষ্ট মান্নান বাগিয়ে নেন কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপারের পদ। সেখানেও টাকা ছাড়া ওসি পোস্টিং দেননি তিনি। প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি থানায় ওসি পোস্টিং দিতে আব্দুল মান্নান হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসাবে পোস্টিং দিতে নিয়েছেন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। সবশেষ গুরু মনিরুলের ইচ্ছায় ২০২৪ সালের ২৩ জুন সিলেটের পুলিশ সুপার হিসাবে বদলি হন। এখানে এসেও তিনি ঘুস ছাড়া কোনো থানার ওসি পোস্টিং দেননি। সিলেটে যোগদানের পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সিলেট জেলার জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ থানায় ওসি পোস্টিং দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ৬০ লাখ টাকা। এই গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি ফোর্সকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেননি। ফলে ৪ আগস্ট পুলিশ আন্দোলনকারীদের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সময় ৬ জন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং ৩০ থেকে ৪০ জন আহত হন।
প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান তার নিজ কার্যালয়ে ছাত্রলীগকে অস্ত্রশস্ত্র রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন। যে কারণে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ৫ আগস্ট জেলা পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করার পর মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কোনো প্রকার নির্দেশনা না দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান মান্নান। যে কারণে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বাগেরহাটের এসপি আবুল হাসনাত বলেছিলেন-‘একটি ব্যালট একটি বুলেট’ : বাগেরহাটের আলোচিত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সুপার হিসাবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আলোচিত এই পুলিশ সুপার বাগেরহাটে যোগদানের পর বিএনপির কোনো প্রোগ্রামের অনুমতি দেননি। বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে একযোগে প্রত্যেক থানায় নাশকতার মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনের এপিএস ফিরোজুল ইসলামকে পাশে বসিয়ে ‘একটি ব্যালট একটি বুলেট’ বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় আসেন।
৩১ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান বলেন, একটি ব্যালট একটি বুলেট অর্থাৎ ভোটের ব্যালটে যে হাত দিতে আসবে প্রত্যেক ব্যালটের জন্য একটি করে বুলেট থাকবে।
সর্বশেষ ৩১ জুলাই ২০২৪ বাগেরহাট জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান বলেন, ‘আমি নিরপেক্ষ কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে আমি নিরপেক্ষ নই। যেখানে উন্নয়ন সেখানেই ধ্বংস, ঠিক কিনা। বিটিভি ধ্বংস, মেট্রোরেল ধ্বংস। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, দায়িত্ব এখন আমাদের। আপনারা বসে থাকেন আমরা কাজ করব, ঠিক কিনা। আবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন হয়েছে, সরকার সব মেনে নিয়েছে। তারপরও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। গোটা বাগেরহাটে আমরা প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলব। এখানে কোনো নাশকতাকারী, সন্ত্রাসী, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের স্থান হবে না।’-এমন বক্তব্য দিয়ে নিজেই বলেন কথাগুলো রাজনৈতিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন আমার মধ্যেও আছে। এসপির এমন বক্তব্য বাগেরহাটে তখন ভাইরাল হয়। তাকে নিয়ে নানা মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
ফকিরহাট থানার ওসি এসএম আলমগীর কবির বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবর্ষণ, বোমা বিস্ফোরণ, সরকারি স্থাপনা ধ্বংসসহ কয়েকটি অভিযোগে বাগেরহাটের সাবেক তিন এমপিসহ ৩৫ জনের নামে দ্রুত বিচার আইনে গত ৮ জানুয়ারি রাতে ফকিরহাট থানায় মামলা হয়েছে। এই মামলায় বাগেরহাটের সাবেক পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা থাকায় ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।