Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মহান ভাষার মাস

আলোকিত সমাজ গঠনে চেতনার বাতিঘর বইমেলা

Icon

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আলোকিত সমাজ গঠনে চেতনার বাতিঘর বইমেলা

ফাইল ছবি

একুশের বইমেলা আমাদের সবার কাছে একটা তাৎপর্যপূর্ণ উৎসবে পরিণত হয়েছে। সারা বছর বই নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা, পঠন-পাঠন না থাকলেও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরো মাস আমরা একটা উৎসবে মেতে উঠি। সেই উৎসব বর্তমানে ডামাডোলে পরিণত হয়েছে।

আমরা বইমেলার আদর্শ ও উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। বইমেলার জন্ম হয়েছিল একটি জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা ও জন-আকাঙ্ক্ষা থেকে। বইয়ের কোনো বিকল্প নেই জ্ঞান অনুশীলনে, জীবনবোধ অর্জনে। যে কোনো আদর্শে আলোকিত আদর্শিক মানুষ গড়ে তোলায় এ মেলার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কথা কিন্তু মেলাটি এখন আলোড়িত হলেও আলোকিত হতে পারছে না। বইমেলার বসন্ত শুধু রঙের বসন্তে পর্যবসিত হয়ে পড়েছে। এদেশের তারুণ্যের যে আত্মত্যাগী আদর্শিক প্রাণোচ্ছ্বাস-প্রতিবাদী, দ্রোহী চরিত্র, সেই তারুণ্যকে উত্তেজনার কানাগলিতে প্রবাহিত করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলেছে।

প্রতিবছর মেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশ পাচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে কোটি কোটি টাকা; কিন্তু সেসব বইয়ের বেশির ভাগই মানহীন, নিম্নরুচির, চটকদার-যা একটি জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ গঠনের বিপরীত কর্মকাণ্ডে পর্যবসিত। এই একুশ শতকের কেউ যদি ‘ভূতের বাচ্চা’ নিয়ে বই লেখে, তার চাইতে কিম্ভূত আর কী হতে পারে?

বইমেলায় এখন মেলা বসে ‘তিশা’, ‘সাব্রিনা’দের। তাদের নিয়ে যে রুচিহীন তাণ্ডব চলে, সেই কর্মকাণ্ডের সম্মুখীন হতে কোনো ভদ্রলোক বইমেলায় যাওয়ার চিন্তা করতে পারে না। এটা ঘটছে আমাদের প্রকাশকদের অব্যবসায়িক, অপেশাদার চরিত্র ও কাজকর্মের জন্য। তাদের কোনো নিজস্ব ভিশন বা চিন্তা নেই, মিশন তো দূরের বিষয়। এরা সবসময় সরকার তোষণমূলক প্রকাশনায় ব্যস্ত থাকে। এই দলে এমনকি বাংলা একাডেমি পর্যন্ত গা ভাসিয়েছে-এটাই সর্বনাশের মূলে। শুধু শত শত বইই নয়, শত শত স্টলও বইমেলায় বরাদ্দ হয় দলীয় পান্ডাদের তোষণে। আর এই তোষণে পান্ডা থেকে পণ্ডিত্যের ভেতর কোনো ভেদরেখা খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা খুবই মর্মবেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা।

কর্তৃত্ববাদী সরকারের তোষণকারী সমর্থকরূপে, নিজেরাও কর্তৃত্ববাদী অপশক্তি হয়ে উঠেছে বাংলা একাডেমি গত পনেরো বছরে। এই নির্লজ্জ ব্যক্তিত্বহীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বইমেলাকে সত্যিকার আলোকিত জ্ঞানভিত্তিক দেশ গঠনের অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসাবে গড়ে তুলতে বাংলা একাডেমিকেই যথার্থ ভূমিকা নিতে হবে। দলীয় অপরাজনীতিমুক্ত বিদ্যায়তনিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

যদি বলি প্রতিবেশী দেশের একটি ‘রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে’ যে মানের বইমেলার আয়োজন করা হয়, তা আমাদের মেলার চেয়ে অনেক বিদ্যায়তনিক চরিত্রের, তাহলে ভুল বলা হবে না। কোনো দলীয় রাজনীতির পান্ডা-পুরোহিত ওদের মেলায় স্থান পায় না। কিন্তু আমাদের এখানে রাজনৈতিক পান্ডা-পুরোহিতরাই বইমেলায় দাবড়ে বেড়ায়-সাধারণ জ্ঞানপিপাসু পাঠক অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন সেখানে। আমাদের দেশের প্রকাশকরাও পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য আয়োজিত বইমেলায় অংশ নেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো পেশাদারিত্ব তারা শেখেন না। বরং নিজের দেশের বই মেলাটিতে তারা দলীয় পান্ডা-পুরোহিতদের দোসররূপে মেলাটিকে কলুষিত করার কাজে সমান ভূমিকা পালন করেন।

বইমেলা নিয়ে আমার একটি প্রস্তাব জানাই-বইকে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে রাখার জন্য বেশি দামি বইগুলো যাতে অর্ধেক মূল্যে ক্রেতারা পান, সেজন্য বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগগুলো প্রকাশিত বই বিক্রিতে সরকারি প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ, বেশি মূল্যের বইগুলো সরকার কিনে নেবেন এবং ভর্তুকি মূল্যে পাঠকের কাছে বিক্রি করবেন। তাতে সুলভ মূল্যে ক্রেতা বই পাবেন। বই বিক্রি বাড়বে। বাড়বে পাঠের অভ্যাস। জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ গঠনে সরকারের এই ভর্তুকি গোটা দেশের জন্য ভবিষ্যৎ ‘বিনিয়োগ’ হয়ে ফিরে আসবে। এরকম পদক্ষেপ নিলে আমরা আমাদের কিশোর এবং তরুণ সমাজকে বিভ্রান্তির পথ থেকে ফেরাতে পারব। এটা আমার দৃঢ়বিশ্বাস। বই হোক জীবন গঠনের হাতিয়ার, বইমেলা হোক আলোকিত সমাজ নির্মাণের বাতিঘর।

অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম