জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জরিপ
দেশের মানুষ সরকারি সেবায় অসন্তুষ্ট
কমিশনের জরিপে এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ অংশ নেয়

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জনমত জরিপে। এক লাখ ৫০ হাজার মানুষের মতামত নিয়ে দেখা গেছে, দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা, পুলিশি, ভূমিসহ বিভিন্ন সেবা নিয়ে মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে শতভাগ সেবা গ্রহীতা অসন্তুষ্ট। ৫০ শতাংশ মানুষের মতে, ঘুস-দুর্নীতি ছাড়া পুলিশের সেবা পাওয়া যায় না। ৮৪ শতাংশ মানুষ জনপ্রশাসন সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশের বিদ্যমান প্রশাসন ব্যবস্থা জনবান্ধব নয়। ৬৫ ভাগ মানুষ মনে করে বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার অভাব ছিল। ৫৪ ভাগ লোক মনে করেন প্রশাসনকে জনবান্ধব করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ৬৬.৪ ভাগ নাগরিক মনে করেন, সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের সঙ্গে শাসকের মতো আচরণ করেন। ৯৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে এবং ৪২ শতাংশ মানুষের মতে, বিদ্যমান সব সমস্যার মূলে দুর্নীতি প্রধান কারণ। কমিশন জনপ্রশাসন সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইনে নাগরিকদের মতামত সংগ্রহের জন্য এক জরিপ পরিচালনা করে। প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার নাগরিক বিভিন্ন উল্লিখিত জরিপে অংশ নিয়ে মতামত দিয়েছেন।
শনিবার ৬টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সরকার। এর মধ্যে জরিপের মতগুলো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে উঠে এসেছে। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পেশ করেন কমিশনপ্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। তখন কমিশনের সুপারিশ সংবলিত নির্বাহী সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। কমিশন জনপ্রশাসন সংস্কারে দুই শতাধিক সুপারিশ করেছে।
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশন নাগরিক পরিষেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে সেবা নিতে যাওয়া সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে এক জরিপ পরিচালনা করে কমিশন। দপ্তরগুলো ছিল-তহশিলদার অফিস, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস, পুলিশের দপ্তর, আয়কর অফিস, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন অফিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল ও স্বাস্থ্যসেবা। উদ্দেশ্য ছিল পরিষেবা সম্পর্কে নাগরিকদের সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির মাত্রা, তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা জানা এবং সস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ সেবা গ্রহীতা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নির্দিষ্টভাবে প্রায় ৪৬ শতাংশ বলেছেন, তারা নিম্নমানের সেবা পেয়েছেন এবং ওষুধ পাননি জানিয়েছেন প্রায় ১২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা। পুলিশের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশ সেবাগ্রহীতার মতে, ঘুস-দুর্নীতি ছাড়া কাজ হয় না। মাত্র ১৫ শতাংশ বলেছেন, তারা থানায় ভালো ব্যবহার পেয়েছেন এবং ১১ শতাংশ বলেছেন, তাদের পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন সহজেই সম্পন্ন হয়েছে। আর মাত্র ৪ শতাংশ বলেছেন, তারা সঠিকভাবে জিডি করতে পেরেছেন।
তহশিল অফিস, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিসের সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ জানিয়েছেন ঘুস দিতে হয়েছে এবং ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ মনে করেন, তারা কাজ করতে চায় না। ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতা ওই সব অফিসে গিয়ে দুর্ব্যবহার ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন। আয়কর অফিসের ক্ষেত্রে প্রায় ৪২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা আয়কর অফিসে ঘুস ও দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং ১০ শতাংশ হয়রানির শিকার হয়েছেন। তারা ওই অফিসে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন।
পৌরসভা-সিটি করপোরেশনে ৩২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা দুর্ব্যবহারের মুখোমুখি এবং ২৭ দশমিক ৭৫ ভাগ ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রায় ১৩ শতাংশ হয়রানির শিকার হয়েছেন। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংশ্লিষ্ট অফিসের ক্ষেত্রে প্রায় ৪২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা এসব সংস্থার সেবা সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত পানি সরবরাহ পান না। প্রায় ৮ শতাংশ বলেছেন, তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ৩১ শতাংশ মানুষের মতে, সেবা নিতে গেলে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করে সরকারি কর্মচারীরা। ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন ঘুস ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না এবং ৪৬% ভাগের মতে, তারা সেবা চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রায় দুই শতাধিক সুপারিশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বাধ্যতামূলক অবসরের বিধান বাতিল, সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কাউকে ওএসডি না করা, ১৫ বছর চাকরি করার পর পূর্ণাঙ্গ সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার বিধান সংযোজন। জেলা প্রশাসন (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পদবি পরিবর্তন, ডিসিকে ফৌজদারি মামলার অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার প্রদান, বর্তমান ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১ বিভাগ থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগ চালু করার বিষয়ে বলা হয়েছে। সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) নামে একটি নতুন সার্ভিস চালু করা, উপসচিব, যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি, উপসচিব পদে বিদ্যমান প্রশাসন ও অন্য সব ক্যাডারের পদোন্নতির রেশিও ৫০:৫০ করার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। ক্যাডার সার্ভিসগুলোকে ১৩টি ক্লাস্টারে ভাগ করা, প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ বিভাগীয় কমিশনার, এসইএসের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং অন্য সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ মহাপরিচালক (ডিজি)। নতুন করে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) গঠন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে আলাদা সার্ভিসে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
এছাড়া দেশের পুরোনো চার বিভাগকে প্রদেশ করা, নয়াদিল্লির আদলে সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকার চালু করা, নতুন দুটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠন, সেবা সম্পর্কিত বিষয়ে সংসদীয় কমিটির আদলে জেলা ও উপজেলায় গণশুনানির জন্য কমিটি গঠনসহ দুই শতাধিক সুপারিশ করে কমিশন।