মহান ভাষার মাস
বই হোক শুদ্ধতম সৃষ্টি

শাহাবুদ্দীন নাগরী
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ ‘মুক্তধারা’ এবং তার প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির মূল ফটকে চাদর বিছিয়ে বই বিক্রয় শুরু করেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন বের করত একুশে সংকলন, তারাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-দাঁড়িয়ে বিক্রয় করত সেসব। বইমেলার শুরুটা এভাবেই।
কিন্তু মাত্র একটি দিনে বই বিক্রয়ের সূচনা হলেও এর ব্যাপ্তি ও বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা শুরু হয় আরও পরে, ১৯৭৮ সালে, বাংলা একাডেমি এই বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণের পর। বাংলা একাডেমি তথা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখন ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এই বইমেলার আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি সে সময়টায় চট্টগ্রামে থাকতাম, বইমেলা দেখার জন্য দু-চার দিনের জন্য ঢাকায় আসতাম।
লেখক বন্ধুদের সঙ্গে রোজ মেলার মাঠে আড্ডা দিয়ে ফিরে যেতাম চট্টগ্রামে। ১৯৮৬ সালের শুরুতে চট্টগ্রামের মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর সিগনেট প্রেস থেকে তার তত্ত্বাবধানে ছাপা হয়ে বের হয় আমার প্রবন্ধের বই ‘মহাকালের বাতিঘর’ এবং ছড়ার বই ‘মৌলি তোমার ছড়া’ (সমাজসেবী ও দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোহাম্মদ ইঊসুফ চৌধুরী এবার একুশে পদক পেয়েছেন। তার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা আজ আবারও উচ্চারণ করছি)। সেই বই নিয়ে আমি ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আসি। কোথায় বই বিক্রয়ের জন্য দেওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় মফিদুল হক ভাইয়ের ‘জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী’র কথা। তার স্টলে হাজির হয়ে দশ কপি করে বই বিক্রির জন্য দিই। সেই বইয়ের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তা আর জানার চেষ্টা করিনি কোনোদিন।
১৯৯০ সালে আমি ঢাকায় চলে এলে শুরু হয় আমার মাসজুড়ে বইমেলায় বই কেনা, আড্ডা, দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা লেখকদের সঙ্গে পরিচয়-পরিচিতি, আর বইমেলায় গলাকাটা দামের রেস্তোরাঁয় সবার সঙ্গে চা-সিঙাড়া ধ্বংস। স্মৃতির আড়ালে বহু কিছু চলে গেছে, তবুও মনে পড়ে, ১৯৯০-এর শুরুতে কবিবন্ধু আবিদ আজাদের ‘শিল্পতরু প্রকাশনী’ ঘিরে আমাদের সাহিত্য আড্ডা জমজমাট হয়ে উঠত। গদ্যশিল্পী আবদুল মান্নান সৈয়দের অট্টহাসির কথা কার না মনে আছে? শিল্পতরুর তার অনাবিল অট্টহাসি চমকে দিত চারপাশের লেখক-আড্ডারুদের। ‘শিল্পতরু’র উচ্ছ্বাস বাণিজ্যিক কারণে থিতিয়ে গেলে ১৯৯৩ সালের দিকে কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরকে নিয়ে আমরা চার বন্ধু গড়ে তুলি ‘দিব্যপ্রকাশ’। মেলায় আমাদের আড্ডার জায়গা স্থানান্তরিত হয়ে যায়। নতুন নতুন বই আসে দিব্যপ্রকাশের ব্যানারে। কিন্তু সেটাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও লেখক হিফজুর রহমান ভাই বিদেশি দূতাবাসে চাকরি নিয়ে চলে গেলে ভেঙে যায় ‘দিব্যপ্রকাশে’র অন্তর্নিহিত শক্তি।
গত শতকের শেষের দিকে বর্ধমান হাউসের ভেতরে বইমেলার যে আয়োজন দেখেছি, তা দেখে বই যে একটা অতীব প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বিষয় এবং কালের দলিল ও পাঠকের কাছে সেই দলিল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ও গুরুত্ব প্রকাশকরা অনুধাবন করতেন সৎ চেষ্টা দিয়ে, তা কি এখন কমে গেছে? ভালো বই প্রকাশের একটা তোড়জোড় ছিল সবার ভেতর। তখন দৈনিক পত্রিকাজুড়ে বইয়ের এত এত বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো না, স্টলে স্টলে বিতরণ করা হতো ক্যাটালগ। এখন বই মানেই সামাজিকমাধ্যম আর পত্রিকাজুড়ে বিজ্ঞাপনের হুড়োহুড়ি। মনে পড়ে, ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি মঞ্চে দেশসেরা গুণী লেখকরা বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতেন, সবাই মুগ্ধ শ্রোতা হলে শুনতেন। এখন কি বৈকালিক আলোচনায় তেমন বিখ্যাত আলোচক ও আর মুগ্ধ শ্রোতার সন্ধান মেলে? সে প্রশ্নেরও জবাব নেই আমার কাছে। হয়তো তেমন আলোচনা হয়, কিন্তু বইমেলার অঙ্গন দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ লেখক-পাঠক বর্ধমানমুখো হন না, ফলে সেই রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত তারা।
সবশেষে একটা কথা বলতেই হয়, অনেকে বিরাগভাজন হতেও পারেন কথাটি শুনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের এখন অনেক কবি-সাহিত্যিক-লেখক নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করছেন, শত শত বন্ধুর লাইক-শেয়ার পাচ্ছেন, কিছু টাকা খরচ করলে মুদ্রিত বই বের করা যায়, সেটাও করছেন। এসব বইয়ের মান নিযে ভাবনা নেই, সম্পাদনা নেই, বইমেলা থেকে টিভি মিডিয়ায় লাইভ সম্প্রচারে তুলে ধরা যায় মুখচ্ছবি এবং বলা যায় বই নিয়ে পাঁচ কথা, এই সহজ প্রক্রিয়ায় মেলার ভালো বই আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে।
মনে পড়ে যায়, ১৯৯০ সালে বইমেলায় একদিন ‘টাপুর টুপুর’ সম্পাদক এখলাস্উদ্দিন আহ্মদ ভাই, কথাসাহিত্যিক শওকত আলী ভাই আর আমি বাংলা একাডেমির সিঁড়িতে বসে গল্প করছিলাম। আমার সদ্য প্রকাশিত ছড়ার বইয়ের একটি কপি ব্যাগ থেকে বের করে শওকত আলী ভাইকে উপহার দিই। তিনি বসে বসেই বইটি আদ্যোপান্ত পড়েন, পড়ার পর আমাকে দেখিয়ে দেন একটি শব্দের বানান ভুল রয়ে গেছে। আসলে ওটা আমারই ভুল, সেই দিনটি পর্যন্ত আমি ভুল বানানটাই জানতাম। এখন কি কেউ এভাবে ভুল দেখিয়ে বা ধরিয়ে দেন? বিখ্যাত হুমায়ূন আহমেদ বলতেন যে, বানান শুদ্ধ করে লেখার দরকার নেই তার, সেটা প্রুফরিডার ঠিক করে দেবে। সবাই কি আর হুমায়ূন আহমেদ হন, সবার কি প্রুফরিডার থাকে? আমার জানা নেই। তবে আশা করতেই পারি, আমরা সব দিক থেকেই শুদ্ধতম বই প্রকাশে মনোযোগী হবো।
শাহাবুদ্দীন নাগরী : কবি, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার