পাটকাঠির কালো ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত হাজারো জীবন!
বায়ুদূষণে গ্রাস করে নিচ্ছে ফসলি জমি * ক্যানসারসহ নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ * উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ দিয়েও মিলছে না প্রতিকার
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাটকাঠি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে চারকোল ও ছাই। সারা দেশেই অবৈধভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে কয়েকশ চারকোল কারখানা। পাবনা থেকে শুরু করে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ীসহ যেসব এলাকায় পাট উৎপাদন বেশি হয় সেসব এলাকায় এসব কারখানার সংখ্যা বেশি। কারখানাগুলো থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া বিস্তীর্ণ এলাকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। এর ফলে ওইসব এলাকার জনজীবন চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। স্থানীয়রা আক্রান্ত হচ্ছে মরণব্যাধি ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ কারখানা বন্ধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা বরাবর সম্প্রতি অভিযোগ দিয়েছে কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন ও বাংলাদেশ পার্টিকেল বোর্ড ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। যেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব পাটকাঠি পোড়ানোর কারখানা বন্ধসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির চেয়ারম্যান এম ইব্রাহীম পাটোয়ারী বলেন, চারকোল কারখানা থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তাতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়াও বিষাক্ত সব ক্ষতিকর পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এসব পদার্থ ছোট-বড় সব বয়সি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে মানুষ শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। এমনকি অনেক দিন এই ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকলে মানুষের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ ও কোষ্ঠকাঠিন্যও দেখা দিতে পারে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চারকোল কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় আশপাশের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে পার্শ্ববর্তী মাঠের ফসল ও ফলগাছের পরাগায়ন ব্যাহত হয়। এছাড়া ফসলের জন্য উপকারী পতঙ্গ মৌমাছিও এই এলাকাগুলোতে থাকতে পারে না। পরাগায়নের অভাবে ফলের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। কালো ধোঁয়া মিশে বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। এসব ধোঁয়া ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে বমির প্রবণতা দেখা দিতে পারে। পরিচালনায় ত্রুটির কারণে চুল্লিগুলো থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হতে পারে। যা এক ধরনের শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা বরাবর দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, এক সময় পাটকাঠি দিয়ে রান্না করা ছাড়াও বাড়ির বেড়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। পাটকাঠি জ্বালিয়ে রান্নার কাজ করার সময় জড়িতরা প্রায়ই কাশি, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হাঁপানি ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতেন। বিগত সরকারের সময় অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গণহারে চারকোল কারখানা প্রতিষ্ঠা করায় এখন নতুন সংকটের মুখে বহু মানুষের জীবন।
পাবনার বেড়ার উপজেলায় গড়ে ওঠা চারকোল কারখানায় পাটকাঠি পুড়িয়ে উৎপাদন হচ্ছে কালি। কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ছাইয়ে অতিষ্ঠ কয়েক গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার বাসিন্দা। এছাড়া মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার উমেদপুরে গড়ে ওঠা ছাই তৈরির কারখানার ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সেখানাকার জনজীবন। কালো ধোঁয়ার প্রভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া ও পরিপক্ব হওয়ার আগেই বিভিন্ন ফলফলাদি ঝরে যাচ্ছে। আবাসিক এলাকায় ছাই তৈরির কারখানা করার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে হাজারো মানুষ। প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এছাড়া ফরিদপুর সদর উপজেলায় চারকোল কারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও ছাইয়ে শিবরামপুর, ঘনশ্যামপুর, মাঝারডাঙ্গি ও ধুলদি রাজাপুর গ্রামের ২০ হাজার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহিদ ও হাবপুর ইউনিয়নের দর্পনারায়ণপুর গ্রামে দৌলতদিয়া-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে চারকোল কারখানা। এসব কারখানার পাটকাঠির ছাই থেকে তৈরি কার্বন চীনে রপ্তানি করা হয়। চীনে এগুলো মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ, কার্বন পেপার, ফটোকপির কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশ ও প্রসাধন তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক কামাল হোসেন বলেন, এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা পাটকাঠি বিশেষ চুল্লিতে লোড করে আগুন জ্বালানো হয়। ১০-১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর চুল্লির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে কোনোভাবে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে চার দিন রাখার পর সেখান থেকে বের করে ক্র্যাশিং করে কার্বন প্যাক করা হয়। চুল্লি জ্বালানোর সময় কারখানা থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হয়। এই ধোঁয়াতেই মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে অবাধে চলছে এসব কারখানা। ছাই ও কালো ধোঁয়ায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ নানা বয়সি মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। কারখানাগুলো বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে বারবার লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। দর্পনারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা রাসেল মিয়া বলেন, কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় আশপাশের আকাশ কালো হয়ে যায়। খাবারের ভেতরে গিয়ে কালি পড়ে। কালি পড়ে বিছানা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার কারণে রাতে ঘরে থাকা যায় না। ঘরে থাকলেও চোখ জ্বলে। শিশুরাও ঘুমাতে পারে না।