মুক্তি মিলবে না সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা ছাড়া
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![মুক্তি মিলবে না সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা ছাড়া](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/06/Siraj-6737023496f36-67a3fefbb44aa.jpg)
স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে একটা দল ফ্যাসিবাদ কায়েম করল, গণতন্ত্র হত্যা করল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করল, বিরোধী দলকে দমন করল এবং বৈষম্য বৃদ্ধি করল; দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের যে কর্মকাণ্ড চালাল-এর বিরুদ্ধে এ পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ছিল। এ পরিবর্তন গণতান্ত্রিকভাবে ঘটতে পারত, সেটা ঘটলে যারা আজ পলাতক, তাদের জন্য সুবিধাজনক হতো। আর এত ক্ষতি হতো না, এত হাজার হাজার মানুষ-প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা গেল, এসব ঘটত না যদি অবৈধ ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকার হত্যাকাণ্ড না ঘটাত। কাজেই যা ঘটেছে, তা হচ্ছে-একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। এই পরিবর্তন প্রয়োজনীয় ছিল, অবশ্যম্ভাবী ছিল। ঘটনাটা একটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ঘটল। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঘটল না। কিন্তু যেটা প্রয়োজন, সমাজের যে পরিবর্তন, সেখানে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসেনি। রাষ্ট্রীয় যে ব্যবস্থাপনা, সেখানেও কোনো পরিবর্তন আসবে না-নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরেকটি সরকার আসবে। কিন্তু সেই সরকারও এই উন্নয়নের যে পুঁজিবাদী ভাঁওতা সৃষ্টি করেছে, যা সমাজে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করেছে, দেশপ্রেমকে নিচের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, উন্নয়নের নামে পুঁজি পাচার করছে, এই উন্নয়নের ভাঁওতা অব্যাহত থাকবে-আর সেটাই হচ্ছে আমাদের উদ্বেগের এবং কষ্টের জায়গা।
এই পুঁজিবাদী উন্নয়ন বাংলাদেশের মানুষের কোনো মুক্তি তো আনেইনি, বাংলাদেশের মানুষের জন্য কোনো বৈশ্বিক তাৎপর্য ও অর্জনও আনেনি। ফলে এ অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে না। যা আমাদের দেশে প্রয়োজন, তা হলো একটি সামাজিক বিপ্লব। এখানে যা হয়েছে, একে কিছুটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা যায় দৃশ্যত। তবে আমাদের দেশের বুর্জোয়ারা মোটেই বিনিয়োগ করে না। বুর্জোয়ারা এখানে লুণ্ঠন করে। বুর্জোয়াদের ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে যার মিল নেই। বুর্জোয়ারা এখানে অধঃপতিত ফলে ন্যূনতম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিবেশও দেশে নেই।
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করছে, এটি সাত্যিকার সমাজ বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষায়। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যে জমিদার ও প্রজার সম্পর্কের পত্তন করেছে, সেটাই পুনরুৎপাদিত হয়েছে সময়ে সময়ে; ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে বৈষম্য, সেটা দূর হয়নি বরং বেড়েছে।
এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সুযোগ ও মানবিক অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে থাকবে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি।
এজন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, যা খুবই জরুরি। বাংলাদেশে এখন একটা সাংস্কৃতিক শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সমাজের মানুষের মধ্যে সংহতি, ঐক্য তৈরি করে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্ররা বিচ্ছিন্ন, চিন্তাচেতনার আদান-প্রদানের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করা যাচ্ছে। ঢাকা কলেজের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটছে। বেসরকারি কলেজের সঙ্গে কবি নজরুল কলেজের বিবাদ তৈরি হচ্ছে। তিতুমীর কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে যে আন্দোলন করছে, এর জন্য সৃষ্ট জনদুর্ভোগে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছে-এসবেরই কারণ সাংস্কৃতিক শূন্যতা। এটা শুধু ঢাকা শহরে নয়, দেশের সর্বত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে ছাত্র-যুবকদের যে অপরিসীম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এই গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটল, সেই অর্জনকে ম্লান করে দেওয়া হচ্ছে। এ সাংস্কৃতিক শূন্যতা পূরণের জন্য প্রয়োজন সংস্কৃতিচর্চাকে জোরদার করা। এ সংস্কৃতিচর্চা হবে আদর্শিক, যার লক্ষ্য হবে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন আনা। সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনা কঠিন কাজ; কিন্তু সেটাই একেবারে অপরিহার্য। সাংস্কৃতিক কাজ কিন্তু কেবল বিনোদন না, সেটা একধরনের আদর্শিক চেতনাকে বিস্তৃত করার কাজ। প্রশ্ন আসে-কারা এটা করবে? করবে যারা হৃদয়বান, বিবেকবান এবং যারা উপলব্ধি করে প্রচলিত ব্যবস্থাটা ক্রমাগত মানবাধিকারকে নিচের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, নিষ্পৃষ্ট করছে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। সমাজে বৈষম্যকে অসহনীয় মাত্রায় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে যদি আমরা সমষ্টিগত উদ্যোগ না নিই তবে জুলাইয়ের এই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পথ হারাবে।
আর চূড়ান্ত কথা হচ্ছে-পৃথিবীতে এখন ব্যক্তিমালিকানার যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন সামাজিক মালিকানার যুগ। সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমরা মুক্তি পাব না। এটা সারা বিশ্বের সমস্যা। সারা বিশ্বে এখন গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই, আমেরিকায় ট্রাম্প নির্বাচিত হয়, উপমহাদেশে মোদিরা রাজত্ব করে, ইউরোপজুড়ে দেখা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদীদের পুনরুত্থান। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানার চূড়ান্ত পরিণতির বর্বর অভিব্যক্তি। বায়ান্নর একুশের চেতনা-১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মুক্তির চেতনার ধারবাহিকতায় জুলাই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পথ হারাবে না যদি আমরা সমাজ পরিবর্তনের অনিবার্য সত্যকে স্মরণ রাখি।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ