মহান ভাষার মাস
একুশ ও চব্বিশের মর্মে গাঁথা জন-আকাঙ্ক্ষা
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. মাহবুব হাসান
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![একুশ ও চব্বিশের মর্মে গাঁথা জন-আকাঙ্ক্ষা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/04/Untit-67a14d704e045.jpg)
না, আমি কোনোটার সঙ্গে কোনোটাকে মেলাতে চাই না। কিন্তু আমাদের চেতনার রং তো লেপ্টে থাকে। যেখানে আমরা একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করব কেমন করে? আমি জানি না, কীভাবে মেলাব। আমরা এটাও জানি, মেলানোটাই রীতি। এই রীতি ভেঙে নতুন রীতি ও পদ্ধতি কায়েম করাই হলো সৃষ্টিশীল মানুষের কাজ। মানুষ ভাবতে পারে, ভাবতে শিখেছে সে তার প্রয়োজনকে খুঁজে নেওয়ার জন্য।
উপমহাদেশের মানুষ ধান বীজ খুঁজে পেয়েছিল জলা-জঙ্গলে। এই ধানকে তারা চাষাবাদের পদ্ধতিতে এনে তাকে ফসল করে তুলেছে। এটা উদ্ভাবনী চিন্তার কাজ। ওই উদ্ভাবনী চিন্তার মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের চেতনাগত অধিকার, আমাদের চাওয়াপাওয়ার বিষয়। আমরা কি ১৯৫২ সালের আগে এটা চিন্তা করেছি যে আমাদের ভাষার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিহ্ন থাকা প্রয়োজন? জিন্নাহ যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, এর বিপরীতে আমরা বললাম-আমাদের বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কেননা, পূর্ববাংলায় বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা বেশি। পাকিস্তানি শাসকরা তা মানতে রাজি ছিল না।
তাদের চেতনায় ছিল-তারা যেহেতু শাসক, তাই তারা যেটাকে ভালো বলে মনে করেছেন, সেটাই হবে। তারা ক্ষমতায়, তাই তারা শাসক আর আমরা ক্ষমতার বাইরে, শাসিত মানুষ, মানে গ্রামে-গঞ্জের মানুষ, তাই আমরা প্রান্তিকজন। আমাদের দাবি না মানাতেই কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আমরা ফুঁসে উঠেছিলাম ১৯৪৮-এ একবার, উর্দু চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ভাষার অধিকার বরবাদ হতে দেব না।
১৯৫২ সালে আরেকবার জীবন দিয়ে আমরা বললাম, সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি মানতে হবে। তারা মানেনি। তারা গুলি করে মানুষ মেরেছে। আমাদের দমন করতে চেয়েছে। মরে আমরা বেঁচে গেলাম।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। সেসময় দমন করেছিল শাসক হাসিনা সরকার। ২৪-এর আন্দোলনও দমনের চিন্তা করেছে। কিন্তু এবার প্রতিনিয়তই আন্দোলন সংস্কার হয়েছে প্রয়োজনকে সামনে রেখে।
হাসিনা সরকার যতই উদ্ধত আচরণ করেছে, ততই সংহত হয়েছে আন্দোলনের অরাজনৈতিক রূপ। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সমাজের চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ নেমে এসেছে তাদের ছেলেমেয়েদের পাশে। স্বৈরাচারী হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অগণতান্ত্রিক ও বর্বর সিদ্ধান্তে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন স্বৈরাচার পতনের ১ দফায় পরিণত হয়েছে।
এ দুটি আন্দোলনের মিল হচ্ছে গণবিক্ষোভ আর গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিধি। আর অমিল হচ্ছে চিন্তার পার্থক্য। একুশে ছিল ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করার সাহস। আর ২৪-এর গণবিক্ষোভ কারফিউ ভেঙে পরিণত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণে। আর শেষ স্তরে এসে ১ দফায় স্থির হয়েছে। চরিত্রগতভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আর বাংলাদেশি শাসক হাসিনার একরোখা হত্যাযজ্ঞ চালানো সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারিতাই কেবল নয়, দানবীয় চিন্তার ফল।
অবৈধ ক্ষমতাদর্পী হাসিনার পাশে ছিল ভারতের চরদের উসকানি, যাতে দেশটি তাদের করায়ত্ত হতে দেরি না হয়। অর্থনৈতিকভাবে গুঁড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সবকিছু ধ্বংস করাই ছিল হাসিনার লক্ষ্য। অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে দিতে পারলেই হাসিনা তার প্রতিবেশীকে ডেকে আনতে পারত। আমাদের সাহস আর দেশকে স্বৈরাচারী দানবের হাত থেকে মুক্ত করাই ছিল ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মর্মে গাঁথা জন-আকাঙ্ক্ষা। আজ সেই জন-আকাঙ্ক্ষারই বিজয় অর্জিত হয়েছে।
কিন্তু জনগণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য এ বিজয়কে ম্লান করে দেওয়া। নতুন নেতাদের এটা মনে রাখতে হবে যে তারা ইতিহাসের সেই মোড়টিতে এসে উপস্থিত হয়েছেন, যেখান থেকে দেশকে নিয়ে যেতে হবে সম্ভাবনার সোনালি তোরণের সিংহদুয়ারে।