বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলশানে নিহত আব্দুল গণি শেখ
অসহায় পরিবার অথৈ সাগরে

ছবি: যুগান্তর
রাজবাড়ী সদর উপজেলার আব্দুল গণি শেখ। ১৫ বছর ধরে চাকরি করতেন গুলশানের সিক্সসিজন হোটেলে। ঢাকার উত্তর বাড্ডার গুপীপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত বছর ১৯ জুলাই গুলশানের শাহজাদপুরে গুলিতে নিহত হন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বর্তমানে অথৈ সাগরে পড়েছে পরিবারটি। দুই সন্তানকে নিয়ে বহু কষ্টে দিন পার করছেন স্ত্রী লাকি আক্তার। একবেলা খেতে পান তো আরেক বেলা অন্যের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে। স্বামীর অবর্তমানে পরিবারটির হাল ধরার জন্য ২২ বছর বয়সি ছেলের জন্য একটি চাকরি চেয়ে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো আশার আলো দেখছেন না।
জানা গেছে, স্ত্রী লাকি আক্তার, ছেলে আলামিন শেখ ও ছয় বছর বয়সি মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে সুখেই ছিল আব্দুল গণির সংসার। স্বামীর আয়ে সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও ভালোই ছিলেন তারা। বড় ছেলে আলামিন এইচএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করে ঢাকায় চলে আসে। বাবার সঙ্গে থেকে শেফের কাজ শিখতে শুরু করে। চার বছরের মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে লাকি আক্তার গ্রামের বাড়িতে থাকতেন।
লাকি বলেন, কয়েক বছর আগে গ্রামের বাড়িতে দোতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন তার স্বামী। সেই কাজ আর শেষ করে যেতে পারেননি। বাড়ির একতলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করেন তার স্বামী। বাড়ির রুমসহ আর কোনো কাজ করে যেতে পারেননি। এখন জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন, ঘরের কাজটি শেষ করতে আর্থিক সহযোগিতা পেতে। একই সঙ্গে ছেলের জন্য একটি চাকরি চেয়ে ঘুরছেন বিভিন্নজনের কাছে।
লাকি আক্তার বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় স্বামী বাসায় ছিলেন। অফিসের কল পেয়ে সকালেই রওয়ানা হন গুলশান-২-এ কর্মস্থলের দিকে। শাহজাদপুর বাঁশতলা এলাকায় পৌঁছলে তার মাথায় গুলি লাগে। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সেদিনের ঘটনা মনে করে লাকি যুগান্তরকে বলেন, সকাল ৯টার দিকে তার স্বামী ফোন করে বাড়ির সবার খোঁজখবর নেন। বন্ধের দিনে জরুরি ফোন পেয়ে অফিসে যাওয়ার কথাও জানান। ঢাকার পরিস্থিতি ভালো নয়, মেয়ে ও ছোট ছেলেসহ সবাইকে সাবধানে রাখতে বলেন। তার নিজের জন্যও দোয়া চান। ওইদিন বেলা ১১টার দিকে ঢাকা থেকে এক স্বজন ফোন করে আব্দুল গণির মাথায় গুলি লাগার কথা জানান। এরপর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
লাকি আক্তার বলেন, আমার স্বামী তো কোনো রাজনীতি করতেন না। কোনো দলাদলিতে ছিলেন না। কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকায় টেনেটুনে সংসার চলত। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তান নিয়ে এখন খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে। অথৈ সাগরে পড়ে গেছি আমি। কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। জেলা প্রশাসন থেকে কয়েকবার চাল-ডালসহ বাজার সদায় কিনে দিয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক লাখ সহায়তা পেয়ে স্বামীর ঋণ পরিশোধ করেছেন। বর্তমানে খুব দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে তাকে। সামনে কীভাবে চলবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদেরও ফাঁসি হোক।
গনির বাবা আব্দুল মজিদ শেখ যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার দিন সকালে ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তার ছেলে ঢাকায় থাকে কি না। ওই ব্যক্তিই ছেলের শরীরে গুলি লাগার কথা জানান। ঢাকায় কেউ থাকলে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে বলেন। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে কী করব কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোনোভাবে আরেক ছেলে ঢাকায় থাকার কথা জানালাম। পরে ছোট ছেলে হাসপাতালে যাওয়ার পরই জানতে পারি গণি মারা গেছে।
গনির ছেলে আলামিন শেখ বলেন, আমি বাসায় ঘুমিয়েছিলাম। সকাল ১০টার দিকে মা ফোন দিয়ে জানায়, বাবার মাথায় গুলি লেগেছে। পরে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে বাবার লাশ দেখতে পাই। অনেকগুলো লাশের স্তূপের নিচে চাপা ছিল বাবার লাশ। পুলিশকে বারবার অনুরোধ করতে থাকে লাশ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা লাশ তো দিতেই চায়নি, উলটো আমাকে হুমকি দিয়েছিল। জানা যায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর আবদুল গনির বাবা আব্দুল মজিদ শেখ বাদী হয়ে শেখ হাসিনাসহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনিসহ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের প্রথম সারির নেতাদের আসামি করা হয়।
এ বিষয়ে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বেশকিছু মামলা বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুল গণির মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব র্যাবকে হস্তান্তরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে। তদন্ত কর্মকর্তা নির্ধারণ হলেই মামলাটি র্যাবে হস্তান্তর করা হবে।