মিলেই ৫০ কেজি চালে বেড়েছে ৭০০ টাকা
আমদানি চালের ওপর ভরসা সরকারের
যে স্তরে কারসাজি হচ্ছে, সেখানে মনিটরিং নেই-ক্যাব
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত।
সরকারি গুদামে মজুত পর্যাপ্ত। কৃষকের মাঠের আমনের চাল বাজারে। বেড়েছে সরবরাহ। তবুও কমেনি দাম। উলটো মিল মালিকদের কারসাজিতে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৭০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে মূল্য। এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি আড়তে। দাম বাড়ছে হুহু করে। কেজিপ্রতি চাল কিনতে খুচরা বাজারে ভোক্তাকে ৫-১০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলছে দেড় মাস ধরে। তবুও মিল পর্যায়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দৃশ্যমান তদারকি নেই। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও মূল্য সহনীয় হচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকার মনে করছে, আমদানি করা চাল দেশে ঢুকলেই দাম কমবে।
এদিকে রমজান সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি করা প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রতিবেদনে চাল নিয়ে বলা হয়েছে, দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩৫০-৩৮০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ৪০৬ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬৬ টন চাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ লাখ ৭৪ হাজার ২৪৪ টন বেশি। এ চাল দেশে স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করলে দাম কমবে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চালের স্থানীয় উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সরকার চাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর সরকার ‘এসআরও’ জারির মাধ্যমে চাল আমদানিতে ৬২.৫ শাতাংশ শুল্ক হ্রাস করে ২২ শতাংশ করে। এরপর ৩১ অক্টোবর আরেকটি ‘এসআরও’ জারির মাধ্যমে চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে চাল আমদানিতে ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রাখা হয়।
সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, সাময়িক মজুতদারির কারণে চালের দাম বেড়েছে। তবে চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে। তদারকির মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। কিন্তু বাজারে চিত্র ভিন্ন। গত দেড় মাসের ব্যবধানে এক কেজি সরু চাল কিনতে ক্রেতার সর্বোচ্চ ১০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি মূল্য ঠেকেছে ৮৫-৯০ টাকায়। মাঝারি চালের মধ্যে পাইজাম ও বিআর-২৮ জাতের চাল ৫ থেকে ৭ টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শুক্রবার জানা যায়, মিল পর্যায়ে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল ৩ হাজার ৯০০ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দেড় মাস আগেও ৩ হাজার ৩০০ টাকা ছিল। ভালো মানের প্রতি বস্তা নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৩০০ টাকা, যা আগে ৩ হাজার ৯০০ টাকা ছিল। একটু মাঝারি মানের নাজিরশাইল মিল পর্যায়ে প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ১০০ টাকা, যা দেড় মাস আগেও ৩ হাজার ৬০০ টাকা ছিল। বিআর ২৭-২৮ জাতের চাল বস্তায় বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকা, যা আগে ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা।
কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল বিক্রেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এখন আমনের ভরা মৌসুম। কৃষকের চালও বাজারে এসে গেছে। পাশাপাশি আমদানিও হচ্ছে। এরপরও মিলাররা চালের দাম হঠাৎ বাড়িয়েছে। যে কারণে পাইকারি বাজারেও চালের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, মিল থেকে এনে পরিবহণ খরচ যুক্ত করে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করছি, যা এক মাস আগেও ৩ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করেছি। নাজিরশাইল চালের বস্তা পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকা, যা আগে ৩ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। এছাড়া বিআর ২৭-২৮ জাতের চাল পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করতে হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা, যা এক মাস আগেও ২ হাজার ৬০০ টাকা ছিল।
নওগাঁ মৌ অ্যাগ্রো অ্যারোমেটিক রাইস মিলের ম্যানেজার ইফতারুল ইসলাম বলেন, আমন মৌসুমের শুরুতেই বাজারে ধানের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে স্বর্ণা ধানের দাম আগে ১ হাজার ২০০ টাকা ছিল, সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ১ হাজার ৪০০ টাকা মন। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে জিরা ও কাটারি ধানের। এ দুই প্রকার ধানের দাম বেড়েছে প্রতি মন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাই চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য (২৯ জানুয়ারি) অনুযায়ী সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্য মজুত আছে ১৩ লাখ ৬ হাজার ৭৭১ টন। এর মধ্যে চাল ৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৮৭ টন, ধান ১৪ হাজার ৩৬৩ টন আর গম মজুত ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৯ টন।
শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা, যা এক মাস আগে ৭২-৭৫ টাকা ছিল। নাজিরশাইল কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৯০ টাকা, যা আগে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বিআর-২৮ ও পাইজম প্রতি কেজি ৬৩-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ৫৭-৫৮ টাকা ছিল।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, বাজারে একাধিক সংস্থা তদারকি করে; কিন্তু ভোক্তা এ থেকে সুফল পাচ্ছেন না। পণ্যের দাম বাড়লেই কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু যে স্তরে কারসাজি হচ্ছে, সেই স্তরে মনিটরিং হয় না। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাকে নাজেহাল করার সুযোগ পাচ্ছে।