Logo
Logo
×

শেষ পাতা

র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ

‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশেষ বাহিনী থাকতে পারে না’

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশেষ বাহিনী থাকতে পারে না’

ছবি: সংগৃহীত

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং গুমের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির এই সুপারিশের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তবে মানবাধিকার কর্মীরা ওই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশেষ বাহিনী থাকতে পারে না।

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করে যুগান্তর। তবে এ নিয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, ‘এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করব না।’

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান যুগান্তরকে বলেন, র‌্যাব বিলুপ্তির জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি। যৌক্তিক কারণেই র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে এইচআরডব্লিউ। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ বাহিনী থাকা ঠিক নয়। ১৯৭২ সালের পর যেমন রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়, তেমনি ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর র‌্যাব গঠন করে। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যেমন ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে, তেমনি র‌্যাবের বিরুদ্ধেও অসংখ্য নির্যাতন, নিপীড়ন ও গুমের অভিযোগ আছে।

নাসির উদ্দিন এলান বলেন, আমাদের নিয়মিত যে পুলিশ বাহিনী আছে সেটি দিয়েই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বিশেষ বাহিনী হলে বিশেষ কাজ করে। তারা সরকারের আজ্ঞাবহ ভূমিকায় থাকে। তিনি বলেন, র‌্যাব বিলুপ্ত করার পর পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে কোনো লাভ হবে না। তাই নিয়মিত বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে যাতে আইনবহির্ভূত কোনো কাজ না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের নিয়মিত পুলিশ বাহিনী যেন আগামীতে জবাবদিহিমূলক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থায় রূপান্তরিত হয় সেই প্রত্যাশা মানবাধিকারকর্মীদের।

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। ঢাকার রাস্তায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ শুরু হয় ২০০২ সালে। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যায়। এরপর ওই বছরের ২৬ মার্চ কার্যক্রম শুরু করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

র‌্যাব কার্যক্রম শুরু করার পর তাক্ষণিকভাবে জনমনে স্বস্তি এসেছিল। অপরাধ কার্যক্রম ও চাঁদাবাজি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। র‌্যাবের বন্দুকযুদ্ধের সূচনা হয় সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের ‘ক্রসফায়ার’র মধ্য দিয়ে। র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এতে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে র‌্যাব। জেএমবির মতো সংগঠনকে দুর্বল করে দেয় র‌্যাব। বাংলা ভাই বা শায়েখ আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনে। তাছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থি দমনেও সফলতার পরিচয় দেয় র‌্যাব।

বাহিনী হিসাবে র‌্যাব সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে তথাকথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের কারণে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, শুরুর সময় থেকে বিএনপির ক্ষমতার মেয়াদ ২০০৬ সাল পর্যন্ত র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৮০ জন নিহত হয়েছে। তখন থেকেই র‌্যাবের কর্মকাণ্ড বিদেশিদের নজরে আসতে থাকে। ‘ক্রসফায়ার’ ছাড়াও র‌্যাবের বিরুদ্ধে ঘুস, চাঁদা নেওয়া, ডাকাতি এমনকি অন্যের হয়ে জমি দখল করার অভিযোগও ওঠে।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিল-অর্থের বিনিময়ে অন্যের হয়ে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সেটিকে ‘ক্রসফায়ার’ বলে চালিয়ে দেওয়া। এ ধরনের একটি বড় ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসে ২০১৪ সালে। নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। লাশগুলো ভেসে ওঠার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। খুন হওয়া পৌর কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের পরিবার প্রথমে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র‌্যাবের কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুস দিয়ে তার জামাতাকে খুন করানো হয়েছে। পরে এ ঘটনায় জড়িত র‌্যাবের একজন সিনিয়র কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিতর্ক জোরালো হয় ২০১৮ সালে টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হক নিহত হওয়ার পর। এ ঘটনার অডিও সারা দেশে তোলপাড় ফেলে দেয়। একরামুল হকের নিহত হওয়ার সময় এবং তার আগ মুহূর্তে ঘটনাস্থলে মোবাইল ফোনে তিনবার কল এসেছিল। শেষ ফোনকলটি রিসিভ হলেও ঘটনাস্থল থেকে ফোনটিতে কেউ উত্তর দিচ্ছিল না। তবে ঘটনাস্থল প্রান্ত থেকে একটা ভয়াবহ পরিবেশের চিত্র পাওয়া যাচ্ছিল অডিওতে। পাওয়া যাচ্ছিল গুলির শব্দ।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল-সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে গুম করা হচ্ছে। সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সানজিদা আক্তার অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তার ভাই ও বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন এবং আরও কয়েকজনকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। তাদের খোঁজ পর্যন্ত মেলেনি এখনো ।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাব এবং এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, র‌্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০-এর বেশি লোকের অদৃশ্য (গুম) হয়ে যাওয়া এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। আমেরিকা ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর গত তিন বছরের বেশি সময়ে র‌্যাবের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার ঘটনা নেই বললেই চলে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম