কিছুই জানে না পেট্রোবাংলা ও আরপিজিসিএল
এলএনজি ক্রয়ের চুক্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি আমদানি করতে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বড় চুক্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জ্বালানির বিশেষ বিধান বাতিলের পর টেন্ডার ছাড়া এরকম একটি চুক্তি করা ঠিক হয়নি সরকারের। পুরো প্রক্রিয়াটি শেখ হাসিনা সরকারের আমলের মতোই হয়ে গেছে। এতে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। খোদ এলএনজির একক ক্রেতা পেট্রোবাংলা ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) চুক্তির বিষয়ে কিছুই জানে না। অথচ এলএনজির কোনো চুক্তি করতে হলে পণ্যটির একক ক্রেতার মতামত অবশ্যই নিতে হবে। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে চুক্তি করতে হলে উভয় পক্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকতে হয়। সরকার কখনো অন্য দেশের বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারে না। কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে হলে, উভয় দেশের কোম্পানি পর্যায়ে চুক্তি হতে হবে।
এদিকে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের এলএনজি ক্রয়ের এ চুক্তিকে ‘প্রাথমিক ধাপ’ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। বিডা জানিয়েছে. এটিকে এখনো সম্পূর্ণ চুক্তি বলা যাবে না। এটি চুক্তির প্রাথমিক ধাপ। এ চুক্তির ফলে জ্বালানি বিভাগের কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়নি বলেও মনে করছেন জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
যদিও চুক্তির বিষয়ে এলএনজির একক ক্রেতা পেট্রোবাংলা ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) এখনো কিছুই জানে না। সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্ট একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, বিডার চেয়ারম্যানের করা চুক্তি সম্পর্কে তারা অবহিত নয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর তারা চুক্তির বিষয়টি জেনেছেন। তবে জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিডা থেকে তাদের জানানো হয়েছে, এ ধরনের একটি চুক্তি হতে পারে, নাও পারে।
রোববার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানকে উদ্ধৃত করে বলেন, মূল বিষয়গুলো নির্ধারণ করে আলোচনার সুযোগ রেখে স্বাক্ষরিত অবাধ্যতামূলক হেডস অব অ্যাগ্রিমেন্ট (এইচওএ) প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ।
এদিকে রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, একটি সম্পূর্ণ ও বাধ্যতামূলক চুক্তির পথে বাংলাদেশের আইন অনুসরণ করা হবে, যার মধ্যে রয়েছে-পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৬; পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস, ২০০৮ এবং ফরেন প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট (প্রমোশন অ্যান্ড প্রোটেকশন) অ্যাক্ট, ১৯৮০।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের চুক্তি করার আগে অবশ্য সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কারণ, দেশে এলএনজি ক্রয়ের কোনো বেঞ্চমার্ক নেই। এ মুহূর্তে কী পরিমাণ এলএনজি প্রয়োজন, এলএনজির দাম এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গেও কথা বলা উচিত ছিল। এভাবে চুক্তি করা হলে স্বচ্ছতা থাকবে না। সবকিছুতে স্বচ্ছতা আনা উচিত।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, এটা নন-বাইন্ডিং একটা চুক্তি। এটি চুক্তি না, চুক্তির একটি প্রাথমিক ধাপ। এতে আমাদের কোনো অবলিগেশন্স ক্রিয়েট (বাধ্যবাধকতা তৈরি) হয়নি। তিনি বলেন, মার্কিন এ কোম্পানিটি গ্যাস এক্সপ্লোর করবে, তারপর এলএনজি আকারে সরবরাহ করবে। এটি সময়ের ব্যাপার।
গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতি পাঠানোর আগে মার্কিন কোম্পানি আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে করা চুক্তির বিষয়ে বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখেন, ‘এ চুক্তি শুধু বাংলাদেশের শিল্পে ক্রমবর্ধমান নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহই নিশ্চিত করবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কৌশলগত অংশীদারত্বকেও শক্তিশালী করবে।’
চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি ফেসবুক পোস্টে আরও লেখেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ট্রাম্পের নতুন এনার্জি এক্সপোর্ট ম্যান্ডেটের ওপর ভিত্তি করে একটা ল্যান্ডমার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট সাইন করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমরাই প্রথম দেশ কোনো ডিল সাইন করলাম। ট্রাম্প-এর ইলেকশন প্রমিজের মধ্যে ‘ড্রিল, বেবি ড্রিল’ এই স্লোগানটা বেশ পপুলার ছিল। সেটা এই এনার্জি এক্সপোর্টকে ঘিরেই। আমাদের দেশে গ্যাসের বিশাল সংকট। ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ, কর্মসংস্থান ইত্যাদির জন্য আমাদের লং টার্ম গ্যাস সাপ্লাই সলিউশন বের করতেই হবে। মিডল ইস্টের বাইরে আমেরিকা একটা ইন্টারেস্টিং অলটারনেটিভ। কিন্তু এই সাইনিংয়ের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির অ্যাঙ্গেল থেকে। ট্রাম্প সরকারের স্টাইল খুবই ডিফারেন্ট। তারা জাত ব্যবসায়ী। আঁতেল টাইপের কথাবার্তায় নেই। স্ট্রেইট অ্যাকশন দেখতে চায়। লুইজিয়ানার সিনেটর বিল ক্যাসিডি সাইনিংয়ের কথা শুনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল! আগামী বছরগুলোতে আমরা যখনই বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে যাব, আমরা বলতে পারব যে, বাংলাদেশ কিন্তু তার প্রথম পার্টনার ছিল। তার আমেরিকা ফার্স্ট-এর সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশ ফার্স্ট। আর আমাদের জন্য বাংলাদেশের ইন্টারেস্ট ফার্স্ট!’
বিষয়টি নিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে ৫০ লাখ টন তরলীকৃত গ্যাস সরবরাহ করবে মার্কিন কোম্পানি আর্জেন্ট এলএনজি। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বড় ধরনের একটি নন-বাইন্ডিং চুক্তির আওতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছে এ গ্যাস সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্জেন্ট এলএনজি বছরে আড়াই কোটি টন এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতার একটি অবকাঠামো গড়ে তুলছে লুইজিয়ানার পোর্ট ফোরচনে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সেখান থেকে পেট্রোবাংলার কাছে চুক্তি অনুযায়ী এলএনজি বিক্রি করতে পারবে।
চুক্তি প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখানে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিডা কীভাবে মার্কিন বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এটা সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরাই বলতে পারবে। তবে জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বিডা থেকে জানানো হয়েছিল এ ধরনের কোনো চুক্তি হতে পারে, আবার নাও পারে। তবে বিস্তারিত জানানো হয়নি।
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে বিরত থাকাই উচিত। যারা কিনবে তারা জানে না, অথচ চুক্তি হলো। তিনি বলেন, দেশে এলএনজি কেনার কোনো বেঞ্চমার্ক নেই। তাই কার থেকে কোন দামে এলএনজি কেনা হবে, এগুলো স্বচ্ছ থাকা জরুরি।
বুয়েটের অপর একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জ্বালানির বিশেষ বিধান বাতিলের পর টেন্ডার ছাড়া চুক্তি করা হলো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতোই হয়ে গেল বিষয়টি। এতে কোনো স্বচ্ছতা থাকল না।
শনিবার বিডার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত শুক্রবার ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী এবং আর্জেন্ট এলএলসির চেয়ারম্যান ও সিইও জনাথন ব্যাস এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
এ বিষয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্জেন্ট এলএনজি বছরে আড়াই কোটি টন এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতার একটি অবকাঠামো গড়ে তুলছে লুইজিয়ানার পোর্ট ফোরচনে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সেখান থেকে পেট্রোবাংলার কাছে চুক্তি অনুযায়ী এলএনজি বিক্রি করতে পারবে।
জানা যায়, আর্জেন্ট নতুন কোম্পানি। ২০২৩ সালে গঠিত কোম্পানিটির এলএনজি সংক্রান্ত কোনো ব্যবসা নেই। চুক্তির বিষয়ে বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, দেশে গ্যাসের বিশাল সংকট। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান প্রভৃতির জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস সরবরাহের সমাধান বের করতেই হবে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে আমেরিকা একটা ভালো বিকল্প।
জ্বালানি বিশ্লেষক প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এলএনজি কেনার চুক্তি বা সমঝোতা যাই বলি, বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান কেন করলেন? এটা তো জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের করার কথা। তাছাড়া এলএনজি কিনলে তো ডলার দেশ থেকে বের হয়। বিনিয়োগ বোর্ডের কাজ তো দেশে ডলার ঢোকানো। এই হেডস অব অ্যাগ্রিমেন্টটা কোন আইনের বলে করা হলো? এখন তো দ্রুত জ্বালানি আইন নেই, তাহলে বিনা টেন্ডারে একটা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে হেডস অব অ্যাগ্রিমেন্ট হলো কেমনে? এটাকে জিটুজি চুক্তিও বলা যাবে না। কারণ, আরেক পক্ষ বেসরকারি কোম্পানি।’
বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা অন্তত ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে ২৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ১৯০ কোটি ঘনফুট। আমদানি করা এলএনজি থেকে মিলছে ৮৫ কোটি ঘনফুট। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি করছে।
এখন মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে (এফএসআরইউ)। এ দুটি পরিচালনা করছে দেশীয় কোম্পানি সামিট এবং যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি। এলএনজি সরবরাহের জন্য কাতার এবং ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরাসরি এলএনজি সংগ্রহে একাধিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি রয়েছে পেট্রোবাংলার। এছাড়া আরও একটি এফএসআরইউ স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের।