Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ছাত্র-জনতা হত্যায় ২৪শ মামলা

পাঁচ মাসেও শেষ হয়নি কোনো মামলার তদন্ত

দেড় লাখ আসামি, সারা দেশে গ্রেফতার ১২ হাজার * শেখ হাসিনার নামে মামলা ২৭৫টি, আ.লীগ নেতাদের নামে ৬৯৭টি * পুলিশে রদবদল ও তদন্ত কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত চাপে বিলম্ব

আবদুল্লাহ আল মামুন

আবদুল্লাহ আল মামুন

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাঁচ মাসেও শেষ হয়নি কোনো মামলার তদন্ত

ফাইল ছবি

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যায় সারা দেশে ২৪শর মতো মামলা হয়েছে। তবে ৫ মাসের (আগস্ট-ডিসেম্বর) বেশি হলেও কোনো মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। পুলিশের একটি পক্ষ মনে করছে, অভ্যন্তরীণ রদবদল, কর্মকর্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ ও বিশ্বস্ততার জায়গায় যেতে না পারা তদন্তে বিলম্বের বড় কারণ। আইনজীবীদের ভাষ্য, বেশিরভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা ও ইন্ধনকারী’ উল্লেখ করায় এসব মামলা প্রমাণ করে বিচার নিশ্চিত খুবই কঠিন। এছাড়া ঢালাও মামলা ও আসামি বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। তবে অযথা কাউকে হয়রানি করা হবে না বলেও পুলিশ প্রধানের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে। এজন্য জুলাই-আগস্টের মামলার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর, ভুক্তভোগী, আইন ও মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২৪শ মামলা, গ্রেফতার ১২ হাজার : ছাত্র-জনতার হত্যা, গুম, অপহরণসহ নানা অভিযোগে সারা দেশে ২৪শর মতো মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাসহ আসামি প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে দলটির শতাধিক নেতাসহ প্রায় ১২ হাজার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন শতাধিক কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়। সাবেক ও বর্তমান ২৮ কর্মকর্তা কারাগারে আছেন। মামলার উল্লেখযোগ্য অভিযোগ হচ্ছে-আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তারা এতে হুকুমদাতা, অর্থদাতা এবং পরিকল্পনাকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আ.লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ৬৯৭ মামলা : বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে গণহত্যা, হত্যা, গুম ও অপহরণের ৬৯৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ছাড়াও আগে গুম, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের মামলাও রয়েছে। এসব মামলায় ৬৪ হাজার ৭৯২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আসামি ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৮৭ জন। আগস্ট মাসে ২৬৮টি, সেপ্টেম্বরে ২৩৮টি, অক্টোবরে ১০২টি, নভেম্বরে ৭২টি ও ডিসেম্বরে ১৭টি মামলা হয়েছে।

হাসিনার বিরুদ্ধে ২৭৫ মামলা : এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, ৫ মাসে সারা দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৭৫টি। এর মধ্যে ১৫ আগস্ট তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় ঢাকার আদালতে। ওই মাসে মোট মামলা হয়েছে ১০০টি। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বরে ১১১টি, অক্টোবরে ৩৪টি, নভেম্বরে ২৫টি ও ডিসেম্বরে ৫টি মামলা হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ১০০টির বেশি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

শেষ হয়নি কোনো মামলার তদন্ত : একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ৫ আগস্টের পর প্রতিটি থানাসহ পুলিশের সব ইউনিটে বড় পরিবর্তন আসে। ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক রদবদল হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও রদবদল হয়েছে। ফলে জুলাই-আগস্টের বেশিরভাগ মামলাতেই নতুন তদন্ত কর্মকর্তা যুক্ত হয়েছেন। কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম হওয়ায় একেকজনের কাছে অতিরিক্ত মামলা তদন্তের দায়িত্ব পড়ছে। এছাড়া পুরোনো মামলার তদন্ত নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে, আন্দোলনে পুলিশকে প্রতিপক্ষ করে ফেলায় জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় পৌঁছতে বিলম্ব হচ্ছে। এখনো পুলিশের বড় অংশের ভেতরে নানা আতঙ্ক ও শঙ্কা কাজ করছে। এসব কারণে মামলার তদন্ত ধীরে এগোচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে হওয়া মামলা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত চলছে। অকারণে যাতে এসব মামলার তদন্ত থেমে না থাকে এবং সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে কর্মকর্তাদের প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে। তারাও নির্দেশনা মেনে কাজ করছেন।

সুষ্ঠু বিচারে শঙ্কা : আইনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব হত্যা মামলা হয়েছে, তাতে ঘটনাস্থল ও মামলার তারিখ ছাড়া এজাহারসহ সবকিছুই প্রায় অভিন্ন। কোনো কোনো মামলা হচ্ছে ঢাকায় আর আসামি হচ্ছে অন্য জেলায়। ফলে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা ও ইন্ধনকারী’ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এসব মামলা প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত বিচার নিশ্চিত করা অনেক কষ্টকর হবে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের অত্যন্ত বিব্রত করে। এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না যুগান্তরকে বলেন, হত্যা মামলাগুলোর তারিখ ও ঘটনার স্থল বাদ দিলে গণহারে আসামি, গৎবাঁধা অভিযোগসহ সবকিছু একই। কোনো কোনো মামলায় আসামিরাও প্রায় অভিন্ন। ফলে এসব মামলা যে আদৌ টিকবে না, সেটা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠক মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, মামলাগুলোর ধরন, ঢালাও আসামি, গৎবাঁধা অভিযোগ দেখলে বোঝা যায়, এসব মামলা আন্দোলনের মূল চেতনা নস্যাৎ করতে যথেষ্ট। এর ফলে প্রকৃত অপরাধীরা যেমন পার পাবে, তেমনি স্বজনহারা পরিবারগুলো সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি বলেন, কোনো কোনো মামলার কার্যক্রম শেষ করতে ২০ বছরও লাগতে পারে। তখন অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যাবে।

হাসিনাসহ ৪৬ জনের মামলা তদন্তে ২ মাসের নির্দেশনা : শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের মামলার তদন্ত ২ মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১৭ ডিসেম্বর এক শুনানিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালত। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম যুগান্তরকে বলেন, গ্রেফতার করা ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ জন এমপি-মন্ত্রী আর ৮ জন প্রশাসনের (পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী)। তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে আটক রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম