Logo
Logo
×

শেষ পাতা

রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র

ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব

এক এলাকায় ছিনতাই করে আত্মগোপন অন্য এলাকায় * ব্লকরেইড, টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে-পুলিশ

ইকবাল হাসান ফরিদ

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব

সোমবার রাত পৌনে ৩টা। পল্টন থানার বিজয়নগর পানির ট্যাংকের কাছে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন এক প্রাইভেট কারচালক। ছুরিকাঘাতে নিহত হন সাজু মোল্লাহ নামের ওই ব্যক্তি। পরদিন মঙ্গলবার রাত ৯টায় গুলশান-২ নম্বরের ডিএনসিসি মার্কেট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী কাদের শিকদার ও তার শ্যালক আমির হামজাকে কুপিয়ে ৮০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।

একই রাতে মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে টিপু মিয়া নামে এক প্রাইভেট কারচালককে ছুরিকাঘাত করে ২৮ হাজার টাকা এবং একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ছিনতাইকারীরা হানা দিচ্ছে। এমনকি দিনে-দুপুরেও বিভিন্ন যানবাহনে অভিনব কায়দায় ছিনতাই হচ্ছে। এসব অপরাধীর হাতে থাকে দেশীয় ধারালো অস্ত্র। বাধা দিলেই কুপিয়ে জখম করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্লেখযোগ্য তৎপরতা না থাকায় ছিনতাইকারীদের দমানো যাচ্ছে না।

জানা যায়, বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বাস স্টপেজে এসে থামে অছিম পরিবহণের একটি বাস। যাত্রীবেশে ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত। তারা একজন যাত্রীর একটি ফোন ছিনিয়ে নেয়। অন্য যাত্রীরা বাধা দিলে তাদের মারধর করে বাস থেকে নেমে যায়।

বাসের সুপারভাইজার যুগান্তরকে জানান, প্রায়ই এভাবে যাত্রীদের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। বেশি ঘটনা ঘটছে মিরপুর-১ নম্বর, কুর্মিটোলা বাস স্টপেজ, কুড়িল বিশ্বরোড, রামপুরা ব্রিজ এলাকায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে চলাচলকারী ৩ নম্বর বাসের চালক জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এয়ারপোর্ট এলাকা, হাউজবিল্ডিং এবং আব্দুল্লাহপুর এলাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে।

অপর একটি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে হরহামেশাই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তারা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে লোকজনকে কুপিয়ে আহত করে ছিনতাই করছে। ৪ জানুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুরের শ্যামলী হাউজিংয়ের দ্বিতীয় প্রকল্প এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীরা যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই কুপিয়ে টাকাপয়সা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে।

ছিনতাইকারী দলের হামলায় মামুন নামে এক যুবক আহত হন। তিনি আত্মরক্ষার্থে দৌড় দিলে ছিনতাইকারীরা তাকে পেছন থেকে একটি সামুরাই ছুড়ে মারে। এটি তার গায়ে লাগলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। এরপর তাকে কুপিয়ে আহত করে তারা। তিনি জানান, এরা স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এসব যুবকের বিষয়ে ভয়ে এলাকাবাসী মুখ খুলেন না।

স্থানীয় এক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, একইভাবে শেখেরটেক, আদাবর, বেড়িবাঁধ, ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা মডেল টাউন, চাদ উদ্যান, রায়েরবাজার, বছিলা গার্ডেন সিটি, তুরাগ নদের ওয়াকওয়েসহ কমপক্ষে দুই ডজন স্পটে নিয়মিত চলে ছিনতাই। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সুযোগ পেলেই এরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছিনতাইয়ে নামে।

তিনি বলেন, এসব ছিনতাইকারী এলাকারই বাসিন্দা। সবারই মুখচেনা। কিন্তু ভয়ে কেউ এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেন না। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই করে অপরাধীরা পার্শ্ববর্তী কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। যে কারণে এদের গ্রেফতারে হিমশিম খেতে হয়। রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও একই চিত্র। ছিনতাইকারীরা এক এলাকায় ছিনতাই করে গা ঢাকা দেয় অন্য এলাকার বিভিন্ন বস্তিতে।

পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীতে ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় ১৫৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০২১ সালে ১৪৪টি, ২০২২ সালে ১৪৫টি, ২০২৩ সালে ১৯৯টি এবং ২০২৪ সালে ২৪৮টি।

অপর একটি সূত্রে জানা যায়, গত অক্টোবর থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১৮৪ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে।

ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ছিনতাই রোধে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। ব্লকরেইড, টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। কোনো অপরাধী যাতে জামিনে বের হয়ে পুরোনো পেশায় ফিরতে না পারে, সেদিকে নজরদারি আছে পুলিশের।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ছিনতাই রোধে চক্রের নাম শনাক্ত করে অভিযান চলমান রয়েছে। যেসব এলাকায় অপরাধীরা গা ঢাকা দিচ্ছে, সেসব এলাকায়ও অভিযান চালানো হচ্ছে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা মামলা থেকেও কয়েকগুণ বেশি। মামলার হিসাব করে রাজধানীতে অপরাধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মামলাও সঠিকভাবে হচ্ছে না। ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে অনেকেই মামলা করতে যাচ্ছেন না। করলেও যেভাবে ঘটনা ঘটেছে, সেভাবে মামলাটি নেওয়া হয় না।

ডিএমপির এসআইভিএস (সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম)-এর তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত রয়েছে ৩ হাজার ২০০ জন। মূলত বিভিন্ন সময় ধরা পড়া অপরাধীদের প্রোফাইল লিখে রাখা হয়েছে এই সফটওয়্যারে। বাস্তবে অপরাধীর সংখ্যা আরও বেশি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম