ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫-৭ গুণ বেশি
নিঃশ্বাসে ঢুকছে মরণ বিষ
বায়ুদূষণের কারণে বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, মারা যাচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ

শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চলতি জানুয়ারি মাসে বেশ কয়েকবার বায়ুদূষণে প্রথম স্থানে ছিল ঢাকা। এর মধ্যে শুক্রবারও ছিল বায়ুদূষণে প্রথম। ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে টানা পাঁচদিন অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় স্থান করে নেয় বাংলাদেশের রাজধানী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা লাফিয়ে বাড়ছে। সার্বিকভাবে ঢাকার বাতাসে দূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়েও প্রায়ই পাঁচ-সাতগুণ বেশি উঠছে। এ দূষণের কারণে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। মারা যাচ্ছে অন্তত ১ লাখ মানুষ। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
ঢাকার বাতাস দিনদিন মারাত্মক মরণঘাতী হয়ে উঠছে জানিয়ে ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল অ্যাটমস্ফেরিক কেমিস্ট্রির (আইজিএসি) চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার বাতাসের এ দূষণের এ ভয়াবহতা আমরা কিভাবে রোধ করব, তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। কেন বায়ুদষূণ হয় এর কারণ, প্রতিকার নির্ণয় করতে হবে সবার আগে। আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়, গাছপালা- সবুজায়ন কমে যাচ্ছে। ওইসব জায়গায় উলটো বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে ক্রমান্বয়ে দূষণ বাড়ানো হচ্ছে। দুটি জায়গায় বায়ুদূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। তা হলো-গাড়ি-ইঞ্জিন, বিভিন্ন কলকারখানায় জ্বালানি তেল পোড়ানো সেখানে ব্যাপক বায়ুদূষণ হয়। অন্যদিকে কাঠ-লাকড়ি, গার্মেন্ট পণ্যসহ বিভিন্ন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে। এছাড়া কৃষিকাজেও তেল পুড়ছে। এসব জায়গায় যদি অ্যাকশান নেওয়া যায়, তাহলে বায়ুদূষণ কমবে। সবুজায়ন এবং পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সরকারকেই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে। বায়ুদূষণের কারণে ক্যানসারসহ মানবদেহের অধিকাংশ রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বায়ুতেই ভয়াবহ বিষ ছড়াচ্ছে।
বিশ্বে বাতাসের দূষণ নিয়ে কাজ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী শুক্রবার সকাল ৯টায় একিউআই স্কোর ছিল ২৫৫-যা বিশ্বে বায়ুদূষণে ঢাকা প্রথম স্থান। একই দিন ভিয়েতনামের হ্যানয়, উজবেকিস্তানের তাসখন্দ ও ভারতের দিল্লি যথাক্রমে ২৩৪, ২০১ ও ১৮৯ একিউআই স্কোর ছিল। ঢাকায় গত কয়েক বছর ধরে বাতাসে ২৭৬ থেকে ২৮০ মাইক্রোগ্রাম দূষণ নিয়ে একের পর পর ‘এক নম্বর’ অবস্থান করে। সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম ধূলিকণা ও গ্যাসীয় পদার্থকে সহনীয় মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ঢাকার বাতাসে বস্তুকণা ২.৫ নামের অতি সূক্ষ্ম পদার্থ স্বাভাবিকের চেয়েও ৫০০ গুণ বেশি ভেসে বেড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় বায়ুদূষণ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে, এমন কিন্তু নয়। এর আগেও একাধিকবার এ তথ্য সামনে এসেছে। কিন্তু তাতে সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঢাকায় বায়ুদূষণের অন্যতম পথের ধুলো এবং বিভিন্ন নির্মাণস্থলের ধুলোর কারণে বিপজ্জনক হচ্ছে। ১২ মাসই চলে প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি খোঁড়াখুঁড়ি। রাস্তায় নিয়মিত পানি দেওয়া, রাস্তার দুধারে এবং মাঝের অংশে সবুজ বাড়ানো, রাস্তার ভাঙা অংশ দ্রুত সারিয়ে ফেলা এসবের মাধ্যমে পথের ধুলা কমিয়ে আনা সম্ভব। শহরে এবং শহরকে ঘিরে যে সব নির্মাণ হচ্ছে, সেসব নির্মাণস্থলে খুব কঠোরভাবে বায়ুদূষণসংক্রান্ত বিধি শতভাগ কার্যকর করাও জরুরি। তাতেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করবে। শিশু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, বায়ুদূষণ মানবদেহের এমন কোনো রোগ নেই-যা সৃষ্টি করে না। বায়ুদূষণের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুদের স্বাস্থ্য। রাস্তায় শুধু নয়, ঘরের অন্দরমহলেও বায়ুদূষণ হানা দিচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে শিশু থেকে সব বয়সিদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগের সমস্যা বাড়ছে। চর্মরোগ ও চোখের নানা সমস্যার প্রকোপও বাড়ছে। তার পরামর্শ, যতটা সম্ভব নাক চোখ মুখ ঢেকে রাস্তায় বের হওয়া উচিত। বাসায় ফিরে ভালো করে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে হবে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২২ সালে ৬৪ জেলায় বায়ুদূষণের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তথ্যে উঠে আসে, বৈশ্বিক তালিকায় সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা আর দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে গাজীপুরে। তাছাড়া ঢাকার সবচেয়ে বেশি দূষিত তিনটি এলাকা হচ্ছে-এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট ও তেজগাঁও শিল্প এলাকা।
তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা ব্যাংকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দিন দিন ঢাকার বায়ু বিষে পরিণত হচ্ছে। এর প্রতিকারে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ টানা চলছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প। যে উন্নয়ন আরও দূষণ করছে বাতাস-বিষ ছড়াচ্ছে চারপাশে।
নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, তিন মাস ধরে ক্রমাগত রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। এর প্রতিকারে কেউই কথা বলছে না। প্রতিকারে যথাযথ উদ্যোগও গ্রহণ করছে না। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কদের মানবদেহে মরণ রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এখন বিশেষ টিম তৈরি করে শহরকে বাঁচাতে হবে। সব নির্মাণ কাজ ঢেকে করতে হবে। প্রতি শুক্র-শনিবার পানি ছিটাতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের দিয়ে টিম গঠন করে দূষণ এলাকায় দূষণকারী সংস্থা, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে হবে। দূষণ ছড়াচ্ছে এমন যানবাহন দ্রুত সময়ের মধ্যে একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে।