ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
ট্রাইব্যুনাল উদ্বোধনের মাধ্যমে নতুন যুগের সূচনা: প্রধান বিচারপতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সংস্কার করা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষ উদ্বোধন করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে তিনি উদ্বোধন করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনালের সংস্কার করা মূল ভবন ও এজলাস কক্ষ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হলো। তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি ‘ঢাকা হাইকোর্ট’ বা ‘পুরোনো হাইকোর্ট ভবন’ হিসাবে মহান ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনয়ন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচারের শাশ্বত নীতিগুলো অনুসরণের মাধ্যমে তা নতুন মাত্রায় পূর্ণতা পাবে। ট্রাইব্যুনালের প্রতি প্রধান বিচারপতির প্রত্যাশা সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন সাধারণ নাগরিক তার হৃদয় উৎসারিত অকৃত্রিম চেতনাবোধ থেকে সমগ্র জাতির নৈতিক সমর্থনপুষ্ট একটি গণজোয়ার রুখতে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি যে প্রত্যাশা রাখেন, প্রধান বিচারপতিও ঠিক অনুরূপ প্রত্যাশা রাখেন।
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষের উদ্বোধনের সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার, সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধন শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ অভিভাবক হিসাবে আজ এই ভবনটির উদ্বোধন করেছেন। তিনি (প্রধান বিচারপতি) একটি বার্তা দিয়েছেন, আশা প্রকাশ করে বলেছেন, যে ভবনটি বিচারকার্য পরিচালনার জন্য নতুন করে হস্তান্তর করা হলো, সেই ভবনটির একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এ ভবন আগেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আগে ইস্ট পাকিস্তান হাইকোর্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারও আগে গভর্নর হাউজ হিসাবে ব্যবহৃত হতো।
তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভবনটির ঐতিহাসিক একটি মূল্য আছে। সেটির কথা তিনি (প্রধান বিচারপতি) স্মরণ করে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, জুলাই-আগস্টে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, ছাত্র-জনতার যে আকুতি, বিচারপ্রাপ্তি ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি এ ট্রাইব্যুনাল পূরণ করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির জন্য এই ট্রাইব্যুনাল সত্যিকারের একটা ভূমিকা পালন করবে এবং সেই দিনটি দেখার জন্য তিনি (প্রধান বিচারপতি) বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একইভাবে তাকিয়ে আছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকার আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের গুম-খুনসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালের গণহত্যা-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেয়। সংস্কার করা ট্রাইব্যুনালে এ বিচার চলছে। এ ট্রাইব্যুনালই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে পুরোনো হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের একটি টিনশেড ভবনে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছিল। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের মূল ভবনের সংস্কারকাজ চলছিল। সংস্কারকাজ শেষে এ ভবনের উদ্বোধন করা হলো। এখন থেকে মূল ভবনেই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলবে।
মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ : ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে এ অভিযোগ দাখিল করেন সেসময় নিহত আসাদুল্লাহ রাতিনের (১৭) বাবা মো. শফিকুল ইসলাম। শেখ হাসিনা ছাড়াও অভিযুক্তদের তালিকায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর নাম রয়েছে।
অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলন হয়, সে আন্দোলনে হতাহত ও নিপীড়িত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীসহ ১৬ জনকে আসামি করে এ অভিযোগ করা হয়েছে।
আখতার হোসেন বলেন, ‘সব চিন্তার মানুষ যখন ভারতের আগ্রাসনের প্রতিবাদে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম করছিলেন, সেই সময়টাতে এই নিরস্ত্র মানুষগুলোর ওপরে নির্বিচার গুলিবর্ষণ করা হয়। সরকারি হিসাবমতেই, ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ঢাকায় নির্বিচার মানুষের ওপরে নিপীড়ন ও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।’
নিহত আসাদুল্লাহ রাতিনের বাবা শফিকুল ইসলাম জানান, তার ছেলে আহত হলেও চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি হাসপাতালগুলো। বিনা চিকিৎসায় একপর্যায়ে তার ছেলে মারা যান। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিচার দাবি করেন।