যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও নরসুন্দা নদীতে চরম নাব্য সংকট, বন্ধ যাতায়াত পণ্য পরিবহণ
রৌমারীতে ১৫ দিন ধরে ফেরি চলছে না * ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে আটকা থাকছে ফেরি-লঞ্চ * বগুড়ার সোনাতলায় বন্ধ নৌঘাট * কৃষিজমিতে মিলছে না সেচের পানি
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও নরসুন্দা নদীর বিভিন্ন পয়েণ্টে চরম নাব্য-সংকট দেখা দিয়েছে। এতে নৌযান চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নদীতীরের কৃষিজমিতে মিলছে না সেচের পানি। অনেক জায়গায় নৌঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। বগুড়ার সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি এবং সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে যমুনায় চর জেগেছে। এতে নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নদীতীরের কৃষকরা সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই কারণে ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুটের মেঘনায় ফেরি ও লঞ্চ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে আটকা থেকে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রীরা ও পরিবহণ শ্রমিকরা। কুড়িগ্রামের রৌমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদে পনেরো দিন ধরে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে নরসুন্দা নদীতেও নাব্য-সংকটে নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং না হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধির পাঠানো খবর-
বগুড়া : সোনাতলার বাসিন্দারা জানান, বর্ষা মৌসুমে যমুনায় পর্যাপ্ত পানি থাকায় চারবাসী সেচ সুবিধা ও অন্যান্য কাজে পানি ব্যবহার করতে পারেন। বিভিন্ন রুটে নৌযান চলাচলও স্বাভাবিক থাকে। ফলে চরবাসীরা সহজেই নৌকায় উপজেলা সদর ও বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারেন। কৃষকরা নৌকায় কৃষিপণ্য ও তাদের উৎপাদিত ফসল হাট-বাজারে নিতে পারেন। তবে দীর্ঘদিন নদী ড্রেজিং না করায় নদী নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। বিভিন্ন নৌরুটে চর জেগে ওঠায় নৌকা চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই অনেকে হেঁটে যমুনা নদী পারাপার হচ্ছেন। নাব্য সংকটে উপজেলার পাকুল্লা ইউনিয়নের মির্জাপুর খেয়াঘাট, তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের বংশবাড়ি ও পূর্ব সুজাইতপুর খেয়াঘাটসহ বেশ কয়েকটি নৌঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। সোনাতলার যমুনা নদীতে নাব্য সংকট ও নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বীকৃতি প্রামাণিক বলেন, দীর্ঘদিন যমুনা নদীতে ড্রেজিং করা হয়নি। ড্রেজিং করা হলে, চরাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে।
সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে বছরের ছয় মাসের বেশি সময় নাব্য সংকট দেখা দেয়। কাজলা ইউনিয়নের কুড়িপাড়া চরের আজিজার রহমান বলেন, যমুনা নদীতে নতুন চর পড়ায় সেখানে আমরা নানা ধরনের ফসল ফলাচ্ছি। কিন্তু যমুনায় পানি না থাকায় ফসলগুলো আমরা নৌকায় উপজেলা সদরে বিক্রি করতে নিয়ে যেতে পারছি না। উপজেলা সদর থেকে বিভিন্ন সার কীটনাশক নিয়ে আসতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে আমরা এখন ঘোড়ার গাড়িতে উচ্চ ভাড়া দিয়ে কৃষিপণ্য পরিবহণ করছি। এতে আমাদের লাভ কম হচ্ছে। আলতাফ আলী নৌঘাটের মাঝি সাইফুল ইসলাম জানান, যমুনা নদীতে পানি না থাকায় গত ১৫ দিন আগে থেকেই তার নৌঘাট বন্ধ হয়েছে। প্রায় চার লাখ টাকা দিয়ে তিনি ঘাটটি ইজারা নিয়েছিলেন। তার আসল টাকা এখনো ওঠেনি। তাই তিনি এখন লোকসানে আছেন।
রায়পুর ও কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) : রোববার লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুটে ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সকাল ১০টায় ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। ঘনকুয়াশা ও নাব্য সংকটের কারণে শনিবার রাত ৩টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া মজুচৌধুরীর হাটের মেঘনার কাটাখালী এলাকায় সুফিয়া কামাল, কাবেরী ও কুসুমকলী নামের তিনটি ফেরি অর্ধশতাধিক গাড়ি নিয়ে আটকা থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রী, পরিবহণ চালক ও শ্রমিকদের। এতে দুই পাড়ে পারাপারের অপেক্ষায় যাত্রী ও পরিবহণ চালকদের পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে। ভোলার যাত্রী রহমত আলী ও পরিবহণ চালক আবুল কালামসহ একাধিক চালক জানান, প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেজিং করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সঠিক তদারকি না থাকায় ও ভালোভাবে ড্রেজিং না করায় নতুন নতুন ডুবোচর জেগে উঠছে। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবোচরে আটকা থাকতে হয়।
ফেরির মাস্টার শহিদুল ইসলাম জানান, চ্যানেলের মুখ সরু হয়ে পড়ায় ফেরি চলাচল বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফগ লাইট না থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে সামান্য কুয়াশায়ও মাঝ নদীতে ফেরি নোঙর করতে বাধ্য হন তারা। ফলে দু-পাড়ে পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে আটকা থাকতে হচ্ছে দিনের পর। এতে করে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কবে এসব সমস্যা সমাধান হবে তাও নিশ্চিত নয়। এ ছাড়া নদীর বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন চর জেগে উঠেছে। এ কারণে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে ফেরি চলাচল করতে হয়। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। দ্রুত সমস্যা সমাধানের দাবি জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিসির মজুচৌধুরীরহাট ও ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটের কর্মকর্তা মো. আতিকুজ্জামান বলেন, জোয়ার-ভাটার দিকে তাকিয়েই ফেরি ও লঞ্চ ছাড়তে হয়। এতে কমছে রাজস্ব। ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়ার কারণে এ সমস্যা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
বেলকুচি-চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) : চৌহালীর যমুনা নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় জেগে উঠেছে বহু ডুবোচর। এতে পণ্যবাহী নৌকা, জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জানা যায়, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে যমুনা নদীতে নেমে আসে বালু। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে প্রতিবছর। এ কারণে বর্ষায় যমুনার পানি ফুলেফেঁপে পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে তীব্র নদী ভাঙন দেখা দেয়। চৌহালী নৌকা ঘাটের ইজারাদার নুরুল ইসলাম জানান, নৌকা চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এখন ড্রেজিং করে নৌপথ তৈরি করা না হলে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে জেলা সদরের সঙ্গে নৌপথের চৌহালীর যাবতীয় কর্মকাণ্ড স্থরিব হয়ে পড়বে। দ্রুত ড্রেজিং করে নৌ চলাচল স্বাভাবিক করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শওকত মেহেদী সেতু বলেন, নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। নদীতে ড্রেজিং করে নদী ভাঙনরোধ ও নাব্য সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পাবনা : ঘন কুয়াশা ও ডুবোচরের কারণে পাবনার কাজিরহাট-পাটুরিয়া (আরিচা) রুটে ফেরি চলাচলে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে রাতে কোনোভাবেই ফেরি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। দিনের কুয়াশা কেটে গেলে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে। এ অবস্থায় এই রুটের পাবনা অংশে এবং মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় পণ্যবাহী যানবাহনের দীর্ঘ জটের সৃষ্টি হয়েছে। আরিচা ঘাটের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিন জানান, রাতে ফেরি বন্ধ থাকায় যানবাহনের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি : রৌমারী ফেরিঘাটে ব্রহ্মপুত্র নদে নাব্য-সংকট ও ডুবোচর জেগে ওঠায় রৌমারী-চিলমারী নৌ রুটে ১৫ দিন ধরে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও পরিবহণ শ্রমিকরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। রৌমারী ফেরি ঘাটে কাঁচা ও পাকা রাস্তার ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মালবাহী ট্রাক ও ছোট-বড় যানবাহন। বিআইডব্লিউটিএ’র মেরিন অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ফলুয়ারচর, বলদমারা, হকেরচরে নাব্য সংকটে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির লোকজন ড্রজিংয়ের কাজ করছে। আশা করি শিগগিরই ফেরি চলাচল শুরু হবে।
তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) : তাড়াইলে নরসুন্দা নদীর বাঁকে বাঁকে বহু চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। এতেই এই নৌরুট অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বিঘ্নিত হচ্ছে নৌযান চলাচল। মাখনা পাড়ের আশপাশে জেগে ওঠা বিশাল ডুবোচরে প্রায়ই আটকে যাচ্ছে বাণিজ্যিক ও যাত্রীবাহী নৌযান। নদীপারের বাসিন্দা নিতাই বর্মণ বলেন, আমরা চাই সরকার দ্রুত নরসুন্দা নদী খননের ব্যবস্থা করুক।